Wednesday, October 4, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,সপ্তম সংখ্যা,জুন-২০২০আওয়ামী লীগ কী করেছে আমাদের জন্য

আওয়ামী লীগ কী করেছে আমাদের জন্য

মুনতাসীর মামুন : আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেককেই যদি জিজ্ঞেস করি কী করেছে আওয়ামী লীগ আমাদের জন্য, আমি নিশ্চিত অধিকাংশ স্বাধীনতায় নেতৃত্বদান, সংবিধান প্রণয়ন এবং শেখ হাসিনার আমলের কয়েকটি কাজের কথা বলবেন। এর বাইরে কিছুই বলতে পারবেন না। যেমন- দেখলাম জিপিএ-৫ পাওয়া অধিকাংশ বলতে পারছে না অপারেশন সার্চলাইট কী, বিজয় দিবস কবে বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বিষয়টি কী? আওয়ামী লীগ আন্দোলন করতে পারে ভালো, ক্ষমতায় গেলে জনগণ উপকৃতও হয়; কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারে না। প্রতিবেশী ভারতে দেখুন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিশাল বিশাল খণ্ডে তাদের ইতিহাস ও দলিল দস্তাবেজ প্রকাশ করেছে। তাদের নিজস্ব আর্কাইভ আছে। আওয়ামী লীগ তা পারেনি, এর নেতৃবৃন্দেরও এ নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বলে একটি স্থায়ী অফিস করতে পেরেছেন এত বছর পর। অথচ, মূলধারার রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন আওয়ামী লীগ প্রাচীনতম। এ বছর ৭২ বছরে পদার্পণ করেছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বলেছিলাম, আপনার তো এখনও বইপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, লেখেনও, এখন স্থায়ী অফিস হয়েছে। একটা আর্কাইভস করে যান। আমরা যারা এখনও কর্মক্ষম তারা না হয় গুছিয়ে দেব। উনি বলেছিলেন, অবশ্যই করা দরকার। তারপর করোনাভাইরাস। তবে, করোনাভাইরাস যাবে। আর্কাইভস হবে না। হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতা-কর্মী ও গবেষকদের জন্য এটি হতো স্থায়ী উপহার। গত ৫০ বছরে একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোনো দলের কোনো নেতাকে যেচে কোনো পরামর্শ দিতে নেই। সেটি গ্রহণযোগ্য হয় না। তবুও যেচে অনেককে বলি, যদি হয় এই আশায়।
যাক সে-প্রসঙ্গ। ১৯৪৯ সাল থেকে ২০২০। ৭০ বছরের পুরনো দল। অথচ ক্ষমতায় থেকেছে খুব বেশি হলে ২০ বছর। ১৯৫৪-৫৮ সালে যুক্তফ্রন্টের সময় প্রায় দুই বছর, বঙ্গবন্ধুর সময় প্রায় চার বছর, শেখ হাসিনার সময় এক যুগ। যুক্তফ্রন্টের সময় পূর্ববঙ্গ/পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এটি নামে মাত্র ছিল যুক্তফ্রন্ট। সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু সেই সময় ছিলেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে তখনই দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে, উপরি কাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, গরিবরা অপেক্ষাকৃতভাবে খেয়ে-পরে থেকেছে। এখানে আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সময়টুকু যদি বিচার করেন, তাহলে দেখবেনÑ বাংলাদেশের অধিকাংশ কাজের পত্তন বা সম্পন্ন হয়েছে তিন আমলে। আমি এখানে বিস্তারিত বিবরণ দেব না। সংক্ষিপ্ত একটি রূপরেখা প্রদান করব মাত্র।

দুই
প্রায় দু-বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ [১৯৫৬-৫৮]। এ সময়টুকুতে তারা কী কাজ করেছিল তার একটি ধারাবাহিক বিবরণ আমি কোনো গ্রন্থে পাইনি। বিষয়টি আমার খুব অবাক লেগেছে, এমন কী আওয়ামী লীগ সম্পর্কিত কোনো দলিল-দস্তাবেজেও এর উল্লেখ নাই। কিছু কাজের বিবরণ পাই আতাউর রহমান খানের আত্মজীবনী ‘ওজারতির দুই বছর’-এ। তাও অতি সংক্ষিপ্ত তালিকা মাত্র। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মজীবনীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজের একটি বিবরণ পাই। বিভিন্ন তথ্য, সংবাদপত্রের বিবরণ থেকে আমি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের কিছু কাজের বিবরণ দেব।
১. রাজবন্দিদের মুক্তি। এ বিষয়টি সবাই উল্লেখ করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। আতাউর রহমান খান ও অন্যান্য মন্ত্রী জেলে গিয়ে রাজবন্দিদের মুক্তি দেন ও অভ্যর্থনা জানান। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত এ-রকম ঘটনা এদেশে ঘটেনি।
২. ৯২(ক) বা কালাকানুন প্রত্যাহার। এটিও প্রশংসিত।
৩. দুর্ভিক্ষ নিবারণ। সময় লেখেছিল কিন্তু নিবারিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরিপুর গ্রামে গিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি এসেছেন খবর পেয়ে ‘৩ হাজার কঙ্কালসার ব্যক্তি’ সমবেত হয়েছিল। “বিদেশ হইতে খাদ্যদ্রব্য আনাইয়া, বহু জায়গায় লঙ্গরখানা খুলিয়া ও নির্দিষ্ট মূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করিবার ব্যবস্থা করিয়া দেশকে কঠিন দুর্ভিক্ষের হাত হইতে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। এই উপলক্ষে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহের ব্যাপারে যে চেষ্টা ও উদ্যম দেখাইয়াছিলেন তাহা স্মরণযোগ্য। তাঁহার চেষ্টার জন্যই এই কঠিন দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হইয়াছিল।” [বিস্তারিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আত্মকথা]
ধীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে লঙ্গরখানা খুলে প্রায় পাঁচ হাজার লোককে ৩/৪ মাস খাওয়ানো হয়েছিল। এ-সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায় বঙ্গবন্ধুর এক বিবৃতিতে। মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক মানজারে আলম এক বিবৃতি জানান, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের খাদ্য দানের জন্য লঙ্গরখানাসমূহ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। যারা যুক্ত নির্বাচন-বিরোধী তাদের লঙ্গরখানা থেকে খাদ্য দেওয়া হয় না। শেখ মুজিব বিবৃতিতে তা অস্বীকার করে জানান।
“১. বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক সহস্র লঙ্গরখানা পরিচালিত হইতেছে। সকল মত ও পথের অনুসারীদের সমন্বয়ে বর্তমান সরকার কর্তৃক পুনর্গঠিত খাদ্য ও সাহায্যদান কমিটি প্রত্যেক ইউনিয়নে সরকারী কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে এই সকল লঙ্গরখানা পরিচালন করিতেছে।
২. সরকার প্রত্যহ প্রত্যেক লঙ্গরখানায় বিনামূল্যে দুই মণ হইতে তদূর্ধ্বে চাউল সরবরাহ করিতেছেন।
৩. স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাঁদা উঠাইয়া লঙ্গরখানা পরিচালনের ব্যাপারে আকস্মিক ব্যয় নির্বাহ করা হয়।
৪. যে সকল স্থানে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত চাঁদা পাওয়া যায় না, সেই সকল স্থানে সরকার এই সকল আকস্মিক ব্যয় নির্বাহ করিয়া থাকেন। এই উদ্দেশ্যে সরকার এ পর্যন্ত ৮০ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছেন।” [বিস্তারিত, ইত্তেফাক, ০৯.১১.১৯৫৬]
তিনি আরও জানান, মুসলিম লীগ যুক্তি দিয়েছিল, লঙ্গরখানা খুললে পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হয়। ধীরেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, দুর্ভিক্ষ নিবারণে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
৪. প্রত্যেক জেলা মহকুমার হাসপাতাল মেরামতের জন্য বছরে ৪ লাখ বরাদ্দ ছিল। চার বছর যাবত তা খরচ হয়নি। সেই টাকা দিয়ে ১৯৫৭ সালে প্রত্যেক জেলা মহকুমার হাসপাতাল ব্যাপকভাবে মেরামত কাজ হয় ও ‘সর্বত্র হাসপাতালের চেহারা পরিবর্তিত হইয়া যায়।’
৫. ঢাকা মেডিকেল কলেজের নতুন বাড়ি, নার্সেস কোয়ার্টার ও ছাত্রাবাস নির্মাণ শুরু হয়।
৬. চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চালু।
৭. রাজশাহী মেডিকেল কলেজ চালু।
৮. রাজশাহীর সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর, কুমিল্লার চিয়াড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে হাসপাতাল স্থাপন।
৯. টীকা বীজ তৈরি শুরু হয় এবং সেখানে একটি শিক্ষাকেন্দ্র চালু।
১০. জেলা বোর্ডের হাসপাতালসমূহ সরকারি কর্তৃত্বাধীনে আনার প্রচেষ্টা। অনেকগুলি হাসপাতাল আনা সম্ভব হয়েছিল এবং তাতে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছিল।
১১. এক বছরের মধ্যে ৩ হাজার টিউবওয়েল স্থাপন, যার ফলে গ্রামবাসী সুপেয় জল পেয়েছিল।
১২. পরিকল্পনা পরিষদ বা প্ল্যানিং বোর্ড
পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য একটি প্লানিং বোর্ড গঠন করা হয়। অর্থনীতিবিদদেরও এর সদস্য করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। এর জন্য তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা (১৯৫৭-১৯৬০) নেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। আগের দুই বছর বরাদ্দ হয়েছিল ১৯ কোটি টাকা। বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যে কৃষি উন্নয়নে ১১ কোটি, পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৯ কোটি, শিল্পে ২ কোটি, সড়ক নির্মাণ ৪ কোটি, শিক্ষা উন্নয়ন সাড়ে ৪ কোটি, স্বাস্থ্যোন্নয়নে ২.৫০ কোটি, গৃহ নির্মাণ ও পুনর্বাসনে ৫.৫০ কোটি টাকা।
১৩. কৃষি উন্নয়ন
এর জন্য দু-ধরনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এক. পতিত জমি উদ্ধার। দুই. বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে চাষ। জমির খসড়া হিসেবে জানা গেল প্রায় ২৬ লাখ একর জমি পতিত, যার অধিকাংশ হাওর ও বিল, পানি নিষ্কাষণটা যেখানে জরুরি। এ কারণেÑ
(১) ১১০০ পাওয়ার পাম্পের বন্দোবস্ত করা হলো, যা আগে কখনও করা হয়নি
(২) উত্তরাঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানো হলো, যা প্রথম
(৩) হাওর এলাকায় পাওয়ার পাম্প কাজের জন্য ৩০টি লোহার নৌকা নির্মাণ। এটিও আগে কখনও হয়নি
(৪) ছোট-বড় প্রায় ৩ হাজার খাল কাটা। এর ফলে ১৫ লাখ একর জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৩ লাখ মণ চাল
(৫) এক বছরে ধানের জন্য ৪০ হাজার, ডাল ও সরিষার জন্য ১১ হাজার মণ বীজ সরবরাহ। বিদেশ থেকে ২ হাজার পাউন্ড ও ১২ লাখ মণ আলুর বীজ আমদানি করে সরবরাহ
(৬) আগে আট বছরে সাড়ে ১০ লাখ মণ সার বিলি করা হয়েছিল। এ সরকার প্রথম বছর সোয়া ১৫ লাখ, পরের বছর প্রায় দ্বিগুণ সার সংগ্রহ করে। এবং মূল দামের এক-তৃতীয়াংশ দামে তা কৃষকদের সরবরাহ করা হয়। এর ফলে ফসল উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়
(৭) পোকার কারণে উৎপাদিত ফসলের ১০ শতাংশ নষ্ট হতো। এটি হ্রাসের জন্য প্রথম বছর ৩০ হাজার জমিতে ঔষধ ছিটানো হয়
(৮) ফল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১৯৫৭ সালে বিলি করা হয় ২৫ হাজার কলা ও ১ লাখ আনারসের চারা। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০০ একর করে দুটি ফলের বাগান সৃষ্টি। ফল উন্নয়নের জন্য ফ্রুট ডেভলেপমেন্ট বোর্ড গঠন
(৯) রংপুর ও শেরপুরে কৃষি শিক্ষার জন্য দুটি স্কুল; আর ৫টি বিদ্যালয়ে ধান/চাল গবেষণার জন্য গবেষণাগার স্থাপন।
১৪. পশু চিকিৎসা
ময়মনসিংহে পশু চিকিৎসার জন্য ভেটেরনারি কলেজ স্থাপন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা।
১৫. প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ছিল সামান্য। অনেকের বেতন ছিল বাকি। স্কুল বোর্ড সব ভেঙে প্রাথমিক স্কুল সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে শিক্ষকদের বাকি বেতন শোধ ও বেতন বৃদ্ধি।
১৬. উচ্চ শিক্ষা
শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন। পাঁচশালা পরিকল্পনায় ১ হাজার জুনিয়র হাই স্কুল, ৫০০ হাই স্কুল, ৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল, ৪০টি কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ উন্নয়নের ব্যবস্থা। ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয় এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কারে।
১৭. ইডেন গার্লস কলেজ
ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের জন্য নতুন ইমারত, ছাত্রীনিবাস ও বিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য ৪৯ লাখ টাকা মঞ্জুর। ঢাকা কলেজের জন্যও দোতলা ছাত্রনিবাস নির্মাণ সম্পন্ন।
১৮. জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন
আওয়ামী লীগ গঠনের পর থেকে পাট নিয়ে সব সময় আলোচনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুব কম বক্তৃতা আছে যেখানে পাট নিয়ে আলোচনা নেই। পাটের বাজারে স্থিতিশীলতা ছিল না। স্থিতিশীলতা আনার লক্ষ্যে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন স্থাপিত হয়। এর প্রধান কাজ ছিল নির্দিষ্ট মূল্যে পাট কিনে পাটের চোরাচালান বন্ধ করা। পাট চাষিরা যেন ন্যায্যমূল্য পান এটি ছিল আওয়ামী লীগের দাবি। এই সংস্থা গঠন ছিল এর প্রথম পদক্ষেপ।
১৯. অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থা
পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নৌ চলাচলের সুবন্দোবস্ত ছিল না। শৃঙ্খলাপূর্ণ ও সুব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষে ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা আইডব্লিউটিএ গড়ে তোলা হয়।
২০. বিদ্যুৎ ও বাঁধের পরিকল্পনা
পাকিস্তান হওয়ার পর ৩টি বড় পরিকল্পনা গৃহীত হয়Ñ কর্ণফুলি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা, গঙ্গা-কপোতাক্ষ বাঁধ ও তিস্তা বাঁধ। এসব পরিকল্পনার কাজ চলছিল খুব শ্লথ গতিতে কারণ, বিদেশি সাহায্য নির্ভরতা। আতাউর রহমান সরকার এতে গতি আনেন।
কর্ণফুলি বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় ছিল, নিম্নভূমির ৫০০ বর্গমাইল এলাকা বন্যাকবল থেকে রক্ষা করা ও পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৩০০ মাইল নদীপথ সুগম করা।
এই পরিকল্পনা সমাপ্ত হলে কুমিল্লা, যশোর ও খুলনায় শুষ্ককালে পানি সরবরাহ বাড়বে, ফলে শস্য উৎপাদন ২ থেকে ৩ গুণ বাড়বে। ফসলের পরিমাণ হবে প্রায় ১৫ লাখ টন।
তিস্তা বাঁধের পরিকল্পনায় ছিল ১০ কোটি টাকা। পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল তিস্তার ওপর বাঁধ ও ১৩০০ মাইল নদীর শাখা-প্রশাখাসহ ৩০ মাইল দীর্ঘ খাল।
এর ফলে দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় অতিরিক্ত ৩ লাখ মণ শস্য ও ১০ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হয়েছিল।
এগুলো ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অন্তর্গত। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অন্তর্গত ছিলÑ
(১) গোমতী নদী খনন
(২) রংপুরে যমুনা নদীর দক্ষিণ পারে বাঁধ
(৩) হবিগঞ্জে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ
(৪) ফরিদপুরে বড় নদীগুলো নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন
(৫) গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ
(৬) নারায়ণগঞ্জ থেকে চালনা পর্যন্ত নৌ চলাচলের পথ উন্নয়ন।
এগুলোর কাজ প্রায় ক্ষেত্রে শেষ হয়েছিল।
২১. বনসম্পদের উন্নয়ন
বনজ সম্পদ আহরণ করা যেতে পারে এবং তা দিয়ে শিল্প গড়ে উঠতে পারে, রাজস্ব বৃদ্ধি পেতে পারে ১৯৫৬ সালের আগে কোনো সরকার তা চিন্তা করেনি। যেমনÑ কাসালং-এ ৭০০ বর্গমাইল থেকে কখনও কাঠ কাটা হয়নি। এ জন্য ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বনভূমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুটি সার্কেল করা হয় এবং তার ওপর চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্ট পদ তৈরি হয়। বনবিভাগের উন্নতি ও বনসম্পদ দিয়ে শিল্পোন্নয়ন (২২ রকমের)-এর জন্য গঠিত হয় ফরেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন।
২২. রমনা গ্রিন
এসব কর্মসূচির পরম্পরায় ঠিক হয় ঢাকায় একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলা হবে। ২০ লাখ টাকা নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং সৃষ্টি হয় রমনা গ্রিন-এর, যা আমাদের কাছে আজ পরিচিত রমনা পার্ক নামে।
২৩. শিল্পোন্নয়ন ও বাণিজ্য
শিল্পোন্নয়ন ও বাণিজ্যের সুবিধার জন্য কেন্দ্রে বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ ও প্রদেশে শেখ মুজিবুর রহমান নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে আবুল মনসুর ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন আহ্বান করেন। সেখানে কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয় ও কার্যকর হয়-
(১) পূর্ব পাকিস্তানে আলদা আমদানি-রপ্তানির কন্ট্রোলার নিয়োগ
(২) আলাদা লাইসেন্স বোর্ড গঠন
(৩) ‘সেলিং কমিটি ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কমিটি’তে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি নিয়োগ
(৪) আমদানিকারকদের শ্রেণি বিভাগ তালিকা সংশোধন
এগুলো ছিল আগে কেন্দ্রের অধীন। এরপর এটি চলে আসে প্রদেশের হাতে, ফলে শিল্প স্থাপন ও ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি হয়। আতাউর রহমান খান জানিয়েছেনÑ “মাঝারি ধরনের প্রায় ষাটটি নতুন শিল্পের মঞ্জুরী ও লাইসেন্স দেওয়া হয়। বিদেশী মুদ্রা অর্জন ও সঞ্চয়, দেশী কাঁচামালের ব্যবহার আর এই প্রদেশের চাহিদামাফিক দ্রব্য উৎপাদন করাই ছিল এইসব নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠার উৎস।”
২৪. লবণ শিল্প
এখন হয়তো অনেকের অবাক লাগতে পারে যে, লবণ নিয়ে একজন মন্ত্রী সে-সময় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এ প্রদেশে এক সময় ১৬ টাকায় এক সের লবণ বিক্রি হয়েছে, কারণ এর ওপর কর্তৃত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তান বা কেন্দ্রের। তখন চাহিদা ছিল বছরে ১ কোটি টন, উৎপাদিত হতো ৫০ লাখ। এ জন্য লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের জন্য আলাদা দপ্তর ও মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে, লবণ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হয়।
২৫. ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস
ব্রিটিশ আমলে পূর্ব পাকিস্তানের খনিজের কিছু জরিপ হয়েছিল। সুপারিশও ছিল কিন্তু কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। আতাউর রহমান লিখেছেন, ক্ষমতা পেয়েই তিনি ব্যবস্থা নেন। সিলেটে গ্যাস উত্তোলনের জন্য ফেঞ্চুগঞ্জে কাজ শুরু করেন। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়।
২৬. অন্যান্য খনিজ
পিট কয়লা, গারো পাহাড়ে পাথর ইত্যাদি কাজে লাগাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়। গারো পাহাড়ের পাথর দিয়ে প্রচুর পূর্ত কাজ করা হয় বা ঐ প্রথম এই পাথর পূর্ত কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে।
২৭. ঢাকা-আরিচা সড়ক
১৯ শতক থেকেই জনগণের আশা ছিল ঢাকা-আরিচা একটি সড়ক হবে। আতাউর রহমান খান লিখেছেন, “যখন পাঠশালায় পড়ি তখন গ্রাম্য মুরুব্বীরা ও পাঠশালার মাস্টার সাহেবরা গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে দস্তখত ও টিপ নিবার জন্য আমাদের পাঠায়ে দিতেন। ঐসব দস্তখত টিপসহ দরখাস্ত দেওয়া হত কর্তৃপক্ষের বরাবরে ঢাকা-আরিচা পাকা রাস্তা করার জন্য কিন্তু হয় নাই। মন্ত্রিত্ব গঠন করার দিনই এই রাস্তার কাজ আরম্ভ করার জন্য নির্দেশ দেই এবং পরদিনই কাজ শুরু হয়ে যায়।”
২৮. নগরবাড়ি-রাজশাহী সড়ক
প্রায় একই সময় শুরু হয়ে যায় নগরবাড়ি থেকে রাজশাহী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের। মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা-রাজশাহী পথের দূরত্ব কমিয়ে আনা।
২৯. সাভার ডেয়ারি ফার্ম
পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ওমরাও খান একদিন প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন ভালো গরু মহিষ পালন ও প্রজননের জন্য। ৫০০ একর জমি দরকার। সরকারও চেয়েছিল ঐ জাতীয় ফার্ম গড়তে, যার জন্য দরকার ২ হাজার একর। নায়রহাট থেকে সাভার পর্যন্ত ছিল “আট-নয় মাইলব্যাপী এলাকা, জঙ্গলাকীর্ণ গড়” লিখেছেন আতাউর রহমান, “বহুকাল আগে এই বিস্তীর্ণ এলাকা দেখেছি, কোন কাজে লাগতে পারে কি না ভেবেছি, সুযোগ এখন এল। জেনারেল ওমরাওকে বলে তাঁর এক কর্মচারী নিয়ে এলাকা দেখায়ে দিলাম। সবার খুব পছন্দ হল। এখানেই ফার্ম করতে হবে, ভেতর দিয়ে রাস্তা যাবে।” এভাবেই সাভারে ডেয়ারি ও মিলিটারি ফার্মের পত্তন হয়।
৩০. ঢাকা-চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সড়ক
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছিল সেই গ্রান্ড ট্রাংক রোড, যার অবস্থা তখন জরাজীর্ণ। এই রাস্তা সংস্কার বিশেষ করে দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণকাজ এই সরকার সম্পন্ন করে। নারায়ণগঞ্জ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত রাস্তার কাজও এই সরকার শুরু করে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পরিকল্পনা এ সময় গ্রহণ করা হয় ও খুলনা-যশোর সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের ওপর বহু ব্রিজ, বিশেষ করে গোমতী ব্রিজ নির্মাণ শুরু।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-শ্রীহট্ট সড়কের সব পুল নির্মাণ। ফেনী ব্রিজ নির্মাণ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার ধরন্তী গ্রাম থেকে নাসিরনগর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ শুরু।
৩১. স্থায়ী শিল্প ট্রাইব্যুনাল
শিল্প ট্রাইব্যুনাল শুধু স্থাপন নয়। শ্রমিক থেকে শুরু করে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়।
৩২. সার্টিফিকেট ব্যবস্থা বাতিল
আতাউর রহমান খান লিখেছেন, “সার্টিফিকেট থেকে সরকারী পাওনা আদায়ের প্রথা বহুকাল চলে আসছে। এতে জনসাধারণের নিদারুণ কষ্ট হয়। আমরা আইন করে সার্টিফিকেট প্রথা তুলে দিয়ে সমস্ত মামলা মুন্সেফ আদালতে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন বাতিল হওয়ার পর মুন্সেফদের কাজ অনেক কমে গেছে।”
৩৩. স্বাস্থ্য নিবাস
কক্সবাজারে নিজে যান আতাউর এবং তা দেখে মুগ্ধ হন। আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম কক্সবাজার উন্নয়নের পরিকল্পনা নেন। সেখানে সরকারি খরচে প্রথম কিছু কটেজ ও বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। কেন্দ্র এর জন্য ১০ লাখ টাকা মঞ্জুরি দিয়েছিল।
৩৪. ঢাকার উন্নয়ন
ঢাকা শহর উন্নয়নের জন্য দুটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়Ñ
(১) ঢাকা উন্নয়ন সংস্থা বা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট গঠন, যা আমাদের কাছে পরিচিত ছিল ডিআইটি নামে, বর্তমানে রাজউক
(২) গ্রেটার ঢাকা সিটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন।
৩৫. মেঘনা ক্রসবাঁধ
মেঘনায় ক্রসবাঁধ নির্মিত হউক, এ ধরনের একটি স্বপ্ন উপকূলবাসীর মধ্যে ছিল, লিখেছেন মোহাম্মদ তোয়াহা। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ আসে ১৯৫৪ সালে যখন তিনি আওয়ামী লীগ থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। এবং তখন প্রথম মেঘনা ক্রসবাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। তোয়াহা লিখেছেন, “১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে শুরু করে এক মাসের মধ্যেই কাজের প্রধান অংশ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়েছিল। প্রতিদিন ৬ হাজার লোক দিবারাত্র কাজ করে এই বিরাট কাজটি সম্পন্ন করল। ভূমি পুনরুদ্ধার কাজের মধ্যে মেঘনা বাঁধ প্রকল্পটি এদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বাঁধের ফলশ্রুতিতে ৩০ লক্ষাধিক একর জমি সাগরের বুক থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। হাজার হাজার বাস্তুহারা পরিবার নিজেদের পৈতৃক ভিটামাটি ফিরে পেয়েছে।”
৩৬. ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন
বাংলাদেশে জমি আর ধর্ম সমার্থক। এদেশের অধিকাংশ মামলা জমি থেকে উদ্ভূত। এখনও জমি-সংক্রান্ত জটিলতা সম্পূর্ণ নিরসন সম্ভব হয়নি।
তোয়াহা লিখেছেন, আতাউর রহমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ভূমি সংস্কারের লক্ষ্যে ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন। জমিদার, কৃষক সবাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন কমিশনে। তোয়াহা লিখেছেন, মৌল ভূমি সংস্কার না হলেও তারা এমন কতগুলি সুপারিশ করেছিল, যার অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন-
“১. জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০ বিঘায়; ২. আগের জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনা সালামিতে বা বিনামূল্যে বিক্রি করতে হবে। ৩. প্রদত্ত জমি তিন বছরের মধ্যে হস্তান্তর করা যাবে না। তিন বছর পরেও যদি কোনো কৃষক বিশেষ প্রয়োজনে জমি বিক্রয় করতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই সরকারের নিকট তা বিক্রি করতে হবে এবং সচ্ছলতা ফিরে আসলে উক্ত জমি সে পুনরায় সরকার থেকে খরিদ করে নিতে পারবে।” ৪. যতদিন জমি থেকে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি না হবে ততদিন খাজনার রেয়াত। সরকার আশা করছিল তিন বছরের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমা হবে। ৫. দেনার দায়ে জমি নিলামে উঠবে না। ৬. ‘জল যার জলা তার’ এই ভিত্তিতে জলমহাল-এর পত্তনের ভিত্তি দেয়া হয়েছিল, যাতে জেলেরা সুবিধা পায়। ৭. ইজারা প্রথা বিলোপ করে নির্বাচিত বাজার কমিটি গঠন। তারা তাদের আয়ের শতকরা ২৫% বাজার উন্নয়নে ব্যয় করতে পারবে।
তোয়াহা লিখেছেন, “কমিশনের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট বামপন্থী সদস্যগণের উদ্যোগে তা সম্ভব হয়েছিল। কমিশনের এই সুপারিশ বিশেষ করে জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ কমিয়ে ১০০ বিঘা নির্ধারণ করার খবরে আইন সভার জোতদার প্রতিনিধিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।”
ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন বললে কম হবে। আতাউর রহমান সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ছিল জমির ১০০ বিঘা সিলিং নির্ধারণ।
৩৭. উপনির্বাচন
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল ২১-দফার অন্যতম উদ্দেশ্য। পূর্বেকার অভিজ্ঞতা ছিল উপনির্বাচন না করা। আতাউর সরকারের সময় ৭টি আসন খালি ছিল। মওলানা ভাসানী, ইয়ার মোহাম্মদ, শেখ মুজিব ও তোয়াহাকে নিয়ে একটি কমিটি করেন উপনির্বাচনে প্রার্থী নিয়োগ ও জরিপ করার জন্য। সরকার উপনির্বাচন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত করে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৭টি উপনির্বাচনেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। অলি আহাদ লিখেছেন, সরকার কৃতিত্বের সঙ্গে খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করেছিল ফলে উপনির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। অলি আহাদ লিখেছেন, “গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এভাবেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল হিসাবে তাহাদের দেয় ২১-দফা ওয়াদার ২১তম ওয়াদাকে রক্ষা করে।”
৩৮. সার্বভৌম বিচার ব্যবস্থা
আওয়ামী লীগ সরকারের মহত্তম কাজ ছিল বিচার বিভাগকে আলাদা করা। ১৪ মার্চ বিচারমন্ত্রী এ সম্পর্কিত বিল আনেন। বিরোধী দলও এতে বাধা দেয়নি। “ফৌজদারী কার্যবিধি (সংশোধনী) বিলের ফলে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।” [সংবাদ, ১৫.০৩.১৯৫৭]
৩৯. মনোনয়ন প্রথা বাতিল
১৪ মার্চ স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ৫টি বিল উত্থাপন করা হয় এবং পাস হয়। ফলে জেলা বোর্ড, মিউনিসিপালিটি ও ইউনিয়ন বোর্ডে সব প্রকার মনোনয়ন প্রথা বাতিল করা হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে সবাই এসব সংস্থায় নির্বাচিত হবেন।
৪০. পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা
১৯৫৭ সালে নাজির আহমদ ছিলেন সরকারের জনসংযোগ বিভাগের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান। ঐ সময় পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে তিনি জানতে পারেন চলচ্চিত্র শিল্প ও কুটির শিল্প উন্নয়নের জন্য ১ কোটি টাকা দেবে। উপ-সচিবের মাধ্যমে তিনি ১ কোটি টাকার কথা শোনেন। উপ-সচিব বললেন, কর্পোরেশন করলে ঐ টাকা পাওয়া যাবে।
“মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সব শুনে আমাকে তাঁর বাসায় ডাকেন। তখন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শেষ হতে দু’দিন বাকি। শেখ সাহেব আমাদেরকে কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সত্বর কাগজপত্র তৈরি করতে বললেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে অধিবেশনের শেষ দিন [৩ এপ্রিল] শেখ মুজিবুর রহমান এফডিসি ও ইপিসিক প্রতিষ্ঠার জন্যে এক হাতে দুটি বিল পরিষদে অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিনা বাধায় বিলটি পাস হয়ে যায়। আমরা তখন আনন্দিত। আমার চোখের সামনে ভাসছে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি)। ওই দিন সন্ধ্যেবেলায় আমি ও আবুল খায়ের আবার বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় যাই। উৎফুল্লিত শেখ সাহেব বললেন, এফডিসি তো হয়ে গেল, আজগর আলী শাহকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিয়েছি। আবুল খায়েরকে এমডি। আর আপনাকে অপারেটিভ ডিরেক্টর। এখন চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করুন গিয়ে। তাঁর উৎসাহ না থাকলে বোধহয় এদেশে এফডিসি’র জন্ম হতো না। আর হলেও হতো অনেক দেরিতে। আর এদেশে ফিল্ম স্টুডিয়ো করার পেছনে নূরুন আমীন, ইস্কান্দার মীর্জা, এনএম খানেরও অবদান আছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য।”
৪১. চা শিল্প
১৯৫৭ সালে টি বোর্ডের তৃতীয় চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু। চা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার সময়ে তিনি মতিঝিলে চা বোর্ডের নিজস্ব ভবন তৈরি করেন। এবং শ্রীমঙ্গলে পাকিস্তান টি বোর্ডের অধীনে পাকিস্তান টি রিসার্চ স্টেশন বা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
৪২. ২১শে ফেব্রুয়ারি ও বাংলা একাডেমি
অনেক দিনের দাবি ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা। সেটি করা হয়েছিল এবং বাংলা একাডেমি থেকে বাংলায় বই প্রকাশনা শুরু হয়েছিল।
১৯৫৪-১৯৫৮ এই ছিল যুক্তফ্রন্টের আমল। এর মধ্যে কয়েকবার সরকার পতন হয়েছে। আওয়ামী লীগ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে সরকার গঠন করে। ১৯৫৮ সালে সরকার পতন হয়। এরই মধ্যে যে কাজ তারা করেছে তা ঐ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভব বলা যেতে পারে। এখানে কিছু কাজের উল্লেখ করা হলো। কিন্তু বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান উন্নতিকরণ ও শিল্প সম্পর্কিত অনেকগুলো পরিকল্পনা তারা করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠান এখনও টিকে আছে। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত ও বরাদ্দ টাকার পরিমাণ পাওয়া যাবে ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে প্রকাশিত অ্যাসেম্বলি প্রসিডিংস : অফিসিয়াল রিপোর্ট : ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি-তে।

তিন
একটি স্বাধীন ভূখ-ের স্বপ্ন, বাংলাদেশে বসবাসকারী অনেকে দেখেছেন বহুদিন। অতীতে অনেকে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছেন, যদিও তারা বাঙালি ছিলেন না। গত শতকের গত ৪০ বছরেও অনেকে সে-ভূখ-ের কথা বলেছেন, ভারত ভাগ হওয়ার সময় সে-পরিকল্পনাও একবার হয়েছিল।
গত শতকের ষাটের দশকে মওলানা ভাসানীও বাঙালিদের জন্য স্বাধীন ভূখ-ের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্নের রূপ পেয়েছিল একেবারে একজন খাঁটি বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। তিনিই পেরেছিলেন বাঙালিদের জন্য নির্মাণ করে দিতে একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রের সীমানা। বঙ্গবন্ধু বলি, জাতির জনক বলি বা শেখ মুজিব বলিÑ যে নামেই সম্বোধন করি না কেন, বাংলাদেশের কথা বললেই ভেসে ওঠে তার অবয়ব এবং সে-কারণেই তার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে ইতিহাসে এবং সে-কারণেই আমরা তাকে স্মরণ করি বারবার।
১৯৭৫ সালের খলনায়করা যে ক্ষমতা দখলের একটা পাঁয়তারা করেছিলেন অনেকদিন ধরে তারও কিছুটা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন খোন্দকার মোশতাক। আমাদের ইতিহাসের অন্যতম এই খলনায়কের ষড়যন্ত্রমূলক মনোভাবের পরিচয় পাই মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকে। ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা এসে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুকে বলে গিয়েছিলেন সাবধানে থাকতে।
সেদিন একমাত্র খোন্দকার মোশতাককে সেখানে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর তিনি ওয়াজেদ মিয়ার কাছে তদবির করেছিলেন এই বলে যে, তাকে যেন জ্যেষ্ঠতাসহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। আরও পরে, ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে একদিন ড. ওয়াজেদ মিয়া খোন্দকার মোশতাকের বাসায় গিয়ে দেখেন, রশীদ নামে এক মেজর তার সঙ্গে গোপন আলাপ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে জনাব হান্নান কর্তৃক প্রচারিত শেখ মুজিবের ঘোষণাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি ছিল টেপকৃত। ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে ঐ টেপকৃত বার্তাটি সম্প্রচারের পর ইপিআর-এর ঐ বীর সদস্যটি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোনে যোগাযোগ করে পরবর্তী নির্দেশ জানতে চান। তখন বঙ্গবন্ধু জনাব গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে ইপিআর-এর ঐ সদস্যকে সম্প্রচার যন্ত্রটি বলধা গার্ডেনের পুকুরে ফেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ উক্ত স্থান পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেন।”
তথ্যটি ভ্রান্ত কী অভ্রান্ত সে নিয়ে বিতর্কে যাব না। ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমি বুঝি, ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির পত্তন হয়েছিল এবং তা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। সম্প্রতি অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ‘রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে স্পষ্ট ও যুক্তিযুক্তভাবে তা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে ৩৫টি নির্দেশ শেখ মুজিব জারি করেন তা কর্তৃত্ব প্রতিরোধ এবং অস্বীকার করার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগিতা এবং বিপরীত জনমুখী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বাঙালির জনসাধারণের সঙ্গে প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতার ভিত্তি করে করে।…
বাঙালি জনসাধারণ একটি স্বতন্ত্র, বিকল্প, স্বাধীন রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার বোধ যুদ্ধের পূর্ব থেকেই বুকের মধ্যে, হৃদয়ের মধ্যে, বুদ্ধির মধ্যে লালন করতে থাকে।”
একটি দেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ-কথা ইতিহাসে থেকে যাবে কেউ এই সত্য অস্বীকার করতে চাইলেও। এর কৃতিত্ব আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমদ ও আওয়ামী নেতৃত্বে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়; বলা যেতে পারে জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এমন একটি দেশ পেয়েছিলেন যেখানে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন, ৫ লাখেরও বেশি নারী নির্যাতিত হয়েছেন, আহত অগণিত। রাস্তাঘাট, স্কুল সব কিছু প্রায় ধ্বংস, ছিল খাদ্য সংকটও। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু যা করেছিলেন তা বিস্ময়কর। মাত্র ৯ মাসে সংবিধান দিয়েছিলেন একটি জাতিকে। যেখানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি করা হয়েছিল এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের ধারাও সংযোজিত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। আজকের বাংলাদেশের ভিত্তি তিনিই করেছিলেন।
আজ বাংলাদেশে যত প্রতিষ্ঠান কার্যকর দেখছি এবং অনেক আইন ও পুনর্বাসন প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সরকারই গ্রহণ করেছিল। আমরা সেগুলো বেমালুম ভুলে গেছি। একদিক শূন্য থেকে দেশ গড়া, আন্তর্জাতিক চাপ, মানুষের মহাপ্রত্যাশাÑ সব মিলে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু তার মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি গড়া হয়েছিল। আমি এখানে তার ৮৫টির তালিকা দিচ্ছিÑ
বঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে গৃহীত পদক্ষেপ :
০১. অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ জারি, ১১ জানুয়ারি ১৯৭২, বাংলা ২৭ পৌষ ১৩৭৮
০২. আদমজী জুট মিল উদ্বোধন, ১৯৭২, দৈনিক আজাদ, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
০৩. আমদানি নীতি ঘোষণা, ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল
০৪. ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট-১৯৭৫, পাস হয় ১৪ জুলাই ১৯৭৫
০৫. গণপরিষদ অধিবেশন জারি, ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল
০৬. গণপরিষদ আদেশ জারি, ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ
০৭. চতুর্থ সংশোধনী, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫
০৮. জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ গঠন, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২
০৯. জাতীয় পতাকা চূড়ান্তকরণ, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি
১০. জাতীয় রক্ষীবাহিনী, ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ
১১. জাতীয় সংগীত চূড়ান্তকরণ, ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২
১২. জাতীয়করণ, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ
১৩. তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন, ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর
১৪. তৃতীয় সংশোধনী, ২৮ নভেম্বর ১৯৭৪
১৫. বাকশাল, ১৯৭৫ সালের ৬ জুন
১৬. দ্বিতীয় সংশোধনী, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩
১৭. নির্বাচন কমিশন আদেশ জারি, ২৩ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এবং সরকারি হ্যান্ড আউটে
১৮. ন্যাশনাল ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন প্রদানের নির্দেশ, ১২ জানুয়ারি ১৯৭৩
১৯. পরিত্যক্ত সম্পত্তি প্রসঙ্গ, ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১৬ নম্বর আদেশবলে
২০. পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৩টি জেলায় বিভক্ত ১৯৭৫, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৫
২১. প্রথম জাতীয় শোক দিবস, ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২
২২. প্রথম বাংলায় গেজেট প্রকাশ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২
২৩. প্রথম বাজেট, ১৯৭৩ সালের ২ জুন
২৪. বাংলাদেশ সরকার (চাকরি) আদেশ ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ, ১৯৭২)
২৫. বাংলাদেশ সরকার (চাকরি বাছাই) আদেশ, ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ৬৭নং আদেশ, ১৯৭২)
২৬. বাংলাদেশ সরকার (চাকরি বাছাই (সংশোধনী) আদেশ, ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ৯২নং আদেশ, ১৯৭২)
২৭. প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস্ অর্ডিন্যান্স বাতিল, ২৮ আগস্ট ১৯৭৩
২৮. বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক, ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২
২৯. বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স একাডেমি, ১৯৭৩
৩০. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ, ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ ৩২-এর মাধ্যমে
৩১. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ২৭নং আদেশবলে ১৯৭৩ সালে
৩২. বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন, ১৭ এপ্রিল ১৯৭২
৩৩. বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭২, ২৪.০১.১৯৭২
৩৪. বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, ১৯৭৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি
৩৫. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে
৩৬. বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর
৩৭. বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) আদেশ পাস, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৬, ১৯৭২)
৩৮. বাংলাদেশ ভূমি মালিকানা (সীমিতকরণ) আদেশ ১৯৭২, রাষ্ট্রপতির ৯৮নং আদেশবলে
৩৯. বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লায়
৪০. বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি
৪১. বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ১২৯নং আদেশবলে
৪২. বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, ১৯৭২ সালের মার্চ
৪৩. বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী (অবসর) আদেশ ১৯৭২
৪৪. বাংলাদেশ হাইকোর্ট আদেশ জারি, ১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি
৪৫. বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ৭নং আদেশবলে
৪৬. বাংলাদেশ হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার আদেশ ১৯৭২, ১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি
৪৭. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১২৬ নম্বর আদেশবলে
৪৮. বীমা কর্পোরেশন আদেশ জারি, ২৬ মার্চ ১৯৭২
৪৯. বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন ও বঙ্গবন্ধু, ১৯৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি
৫০. বেতবুনিয়া উপকেন্দ্র স্থাপন, ১৪ জুন ১৯৭৫
৫১. মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর, রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৯৫
৫২. মুক্তিযুদ্ধের পদক প্রদান, ১৫.০১.১৯৭৩
৫৩. মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব, ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর
৫৪. যৌথ নদী কমিশন, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে
৫৫. রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২
৫৬. রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব (তৃতীয় সংশোধনী) আদেশ, ৫ আগস্ট ১৯৭২, রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৯৫
৫৭. শিপিং কর্পোরেশন গঠন, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি
৫৮. শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৭৪ সালে ৩১নং ১৯৭৪ অ্যাক্টের
৫৯. সংবিধানের প্রথম সংশোধনী, ১৫.০৭.১৯৭৩
৬০. সরকারি অফিসে বিলাসিতা বন্ধে নির্দেশ, ১৯৭২, দৈনিক আজাদ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
৬১. সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য নির্দেশ, ১৯৭২ সালের ২৫ এপ্রিল
৬২. সশস্ত্র বাহিনী পুনর্গঠন, ১৯৭২, ০৬.০৩.৭২, ০৮.০৪.৭২
৬৩. সস্তায় রেডিও-টিভি দেওয়ার ব্যবস্থা, ২ জুলাই ১৯৭৫
৬৪. সিভিল সার্ভেন্ট ট্রেনিং একাডেমি স্থাপন, দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ এপ্রিল ১৯৭৩
৬৫. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বেতন কমিশন, ১৯৭২ সালের ১৩ জুলাই
৬৬. প্রশাসন ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ
৬৭. বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), ১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর
৬৮. বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ, ১৯৭২
৬৯. বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি
৭০. বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (বিমক), ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশবলে
৭১. বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, ১৯৭২ সালের ৪৬নং আদেশবলে
৭২. ঢাকা কর্পোরেশন সৃষ্টি, ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি
৭৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩
৭৪. ঘোড়দৌড় নিষেধ করে আদেশ, ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি
৭৫. আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই
৭৬. জাতীয় প্রতীক, ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি
৭৭. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ১৯৭৩
৭৮. সাধারণ ক্ষমা, ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর
৭৯. বাংলাদেশ পরমাণু কৃষ্টি ইনস্টিটিউট, ১৯৭৩
৮০. বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৩৪নং আদেশবলে
৮১. শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর
৮২. বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা, ১২৮, ১৯৭২-এর অধীনে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর
৮৩. শিশু আইন, ১৯৭৪ সালের ২২ জুন চিল্ড্রেন অ্যাক্ট
৮৪. ২৯ ব্যাংক বীমা কোম্পানি সরকারি খাতে গ্রহণ, ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি
৮৫. ২৩ মার্চ ৭১ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছুটি

আত্মবিশ্বাস আর সাহসও ছিল তার। দলের ব্যাপ্তি, মানুষের প্রতি ও নিজের প্রতি আস্থা তা আরও বাড়িয়েছিল। সে-কারণে ৬-দফাকে এক-দফায় পরিণত করতে পেরেছিলেন। এ লক্ষ্যে যে তিনি অবিচল ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস ছিল, তা ফুটে ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়।
১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার স্বপ্নের বাংলাদেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখন তার ভূমিকা আর আন্দোলনকারীর নয়। এখন তার ভূমিকা যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’র তা পূরণ করার এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত সে-লক্ষ্যেই অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। ঐ সময়ের মধ্যেই দেশের পুনর্গঠন শুরু হয় এবং আমরা সংবিধান লাভ করি।
বঙ্গবন্ধু বা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল দেশকে একটি শাসনতন্ত্র প্রদান। আর কোনো দেশে এ-রকম একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এত দ্রুত একটি শাসনতন্ত্র প্রদান সম্ভব হয়েছে বলে জানা নেই। এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ৪টি মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, তৎকালীন পরিস্থিতিতে তা খানিকটা র‌্যাডিক্যালও বলা যেতে পারে। শাসনতন্ত্রের মূলনীতিসমূহ ছিলÑ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। মূলত মুক্তিযুদ্ধ যে ক’টি কারণে হয়েছিল শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে তাই বিধৃত হয়েছিলÑ বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা। যে কারণে প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রথমেই মূলনীতিসমূহ, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত হেনেছিলেন। এছাড়া শাসনতন্ত্রে বিধৃত হয়েছিল একজন মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ, রাষ্ট্রের দর্শন। অন্যকথায় এভাবে বিষয়টি দেখা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। আর ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে বিধৃত হয়েছিল সিভিল সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহ। এক কথায় এই শাসনতন্ত্র বাংলাদেশে সিভিল সমাজের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে পত্তন করতে চেয়েছিল।
শেখ মুজিবের হত্যার প্রায় চার দশক পর মানুষ আবার অনুভব করেছে শেখ মুজিব কী ছিলেন। কেন তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছিলেন। মানুষ আজ বুঝতে পেরেছে, তিনি বাঙালিকে বড় করতে চেয়েছিলেন, আর মানুষকে বড় করার একটি পথ নিরস্ত্র মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া। তার হত্যার পর কত দল ও কত জন শাসন করল বাংলাদেশ; কিন্তু মানুষের মন থেকে তো তাকে মোছা গেল না, যে চেষ্টা এখনও অব্যাহত। কারণ, আজ আমরা দেখছি, আমরা একবারই সে মর্যাদা পেয়েছিলাম, সে-পথ একবারই উন্মুক্ত হয়েছিল আমাদের জন্য ১৯৭১ সালে, যখন শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন নিরস্ত্র বাঙালির নেতৃত্বে আমরা সব ধরনের সশস্ত্রদের হটিয়ে দিয়েছিলাম।
এ জন্য আমি গর্বিত, আমার উত্তরসূরিও হবে গর্বিত। বাঙালি ও বাংলাদেশ নামটিই বেঁচে থাকবে সে-জন্য।

চার
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন প্রায় এক যুগ। পূর্ববর্তীদের থেকে তাই তিনি কাজ করার সময় পেয়েছেন বেশি। হ্যাঁ, তাকেও যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে; কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন এবং সফল হয়েছেন।
তার আমলে যে বাংলাদেশ দেখছি, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলছি, ভাবিনি যে এমন বাংলাদেশ দেখে যাব। তার আমলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়েছে এবং মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যমুনা ও পদ্মাসেতু এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মানুষ দুবেলা খাবার পাচ্ছে। ১৭ কোটির দেশে প্রায় কেউ অনাহারে নেইÑ এর চেয়ে বড় কৃতিত্ব আর কী হতে পারে? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখন গণনা করা হয়। সর্বশেষ রোহিঙ্গা সমস্যা ও করোনা মহামারি যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তাও প্রশংসিত।
হাসিনার আমলের কাজের ফিরিস্তি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর কাজের ফিরিস্তি যেমন এক লাইন করে দিয়েছি তেমনি এক লাইন করে লিখলেও তা ১০০ পাতার একটি পুস্তিকা হবে। আওয়ামী লীগই তা প্রকাশ করুক। আমি এখানে মোটাদাগে তার কয়েকটি কাজের কথা তুলে ধরছি মাত্র।
আন্তর্জাতিক ফোরামে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন গণনীয়। এর কারণ দুটিÑ এক. বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, দুই. দ্বি-পাক্ষিক সমস্যাবলির শান্তিপূর্ণ সমাধান। আমি এর সাথে যুক্ত করতে চাই আরও দুটি উপাদানÑ সাধারণের প্রতি মমতা ও তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা এবং অদম্য সাহস। আজ তার সীমান্ত ও সমুদ্র বিজয় সবার কাছে বড় জয় হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে কিন্তু, তার চেয়েও বড় বিজয় বা সাফল্য, আদর্শের ভিত্তিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এসব বিষয় বিবেচনায় না আনলে আজকের সাফল্য সঠিকভাবে প্রতিভাত হবে না।
রাষ্ট্র, বাংলাদেশের আগেও অনেক গঠিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। রাষ্ট্র স্থাপন করা যত কঠিন তার চেয়েও কঠিন রাষ্ট্রবিরুদ্ধ শক্তি, তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিভূকে পরাজিত করে রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিলেন, তারপর বলেছিলেন, এবার রাষ্ট্র রক্ষার দায়িত্ব। রাষ্ট্র রক্ষার অর্থ শুধু তার সীমান্ত অক্ষুণœ রাখা নয়। এর অর্থ যে মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল তা অক্ষুণœ রাখা। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্গত হবে না, সেদিক থেকে রাষ্ট্র অক্ষুণœ; কিন্তু যখন রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ছিন্নভিন্ন হয় তখন রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তান যেমন। বাংলাদেশও ১৯৭৫ সালের আদর্শের জায়গাটা হারিয়েছিল। তা পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ হাসিনা এবং তার মিত্র কিছু মৃদু বাম দল। সেই যে ১৯৮১ সালে ফিরে তিনি লড়াই শুরু করেছিলেন সে-লড়াই এখনও চলছে, চলবে। তিনি না থাকলেও নতুন নেতৃত্ব যদি লড়াই চালিয়ে যায়, তাহলেই বাংলাদেশ আবার পরিপূর্ণভাবে বাঙালির রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

পাঁচ
লড়াইয়ের শুরুতে শেখ হাসিনাকে নিজের দলে নেতৃত্ব দৃঢ় করতে হয়েছে। দলকে পুনর্স্থাপনে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই অগ্রসর হয়েছেন। গণতন্ত্রে প্রথম পদক্ষেপ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই যোগ দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও সরকার ষড়যন্ত্র করবে জেনেও। কেননা রাষ্ট্রে তাকে থাকতে হলে সেখানে তার একটি জায়গা করে নিতে হবে এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসতে হবে। সেই লড়াইটা শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালেই জিতেছিলেন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী করে। রাষ্ট্রপতি শাসন চালু হওয়ার ১৫ বছর পর দেশ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। তার ২৫ বছর আমরা দেখছি সব ধরনের রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষ দুটি বিষয় মেনে নিয়েছেনÑ ১. সংসদীয় রাজনীতি ২. নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। অনেক ব্যক্তি বা দল তা মানতে নারাজ হলেও এটি মেনে নিতে হচ্ছে। যে-কারণে নির্বাচনে না গেলেও নির্বাচনের কথাই বলছে বিএনপি এখন।
১৯৭৫ সালের একটি বড় বৈশিষ্ট্য খুনিদের খুন করার অবাধ লাইসেন্স বা দায়হীনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা পাকিস্তান ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। ১৯৭১ সালে যারা খুন করেছিল, পাকিস্তান তাদের আশ্রয় দিয়েছিল (যেমনÑ গোলাম আজম, নিজামী বা মুজাহিদ), উচ্চপদে বসিয়েছিল (ফরমান আলী বা অন্য কমান্ডারদের)। ১৯৭৫ সালে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দুই-ই দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের খুনিরা তো ছিলই। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান থেকে তারা এক ধাপ এগিয়েও গিয়েছিল, অর্থাৎ খুনিদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধন করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দায়হীনতা থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা তাই ইনডেমনিটি বাতিলে সংবিধান সংশোধন করেছেন। এটি ছিল বড় একটি পদক্ষেপ। ইনডেমনিটি বাতিলের আগে কেউ ধারণা করতে পারেন নি এটি বাতিল হতে পারে এবং অনেকে তা ভুলেও গিয়েছিলেন, মেনেও নিয়েছিলেন। শুধু ইনডেমনিটি বাতিল নয়, তিনি বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগীদের হত্যার বিচারও শুরু করেছিলেন। প্রতিশোধ বাসনা থাকলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করে বিচার করতে পারতেন। তা তিনি করেন নি, বিচারের দীর্ঘপথই বেছে নিয়েছিলেন, অপরাধীদের শাস্তিও বিধান করেছিলেন।
দায়বোধ ফিরিয়ে আনার মানে এই নয় যে, সমাজে সবার ক্ষেত্রে দায়বোধ ফিরেছিল। কিন্তু, দীর্ঘদিন পর এ পদক্ষেপটি নেওয়াতে দায়বোধের বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিল। এই রাষ্ট্রে কেউ আর এই বিচারের বিরোধিতা করার সাহস পাননি। জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে গৃহ যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন। সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার এটি ছিল কৌশল। জাতিকে তিনি দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন আগেই, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে তারপর তা ত্রিধাবিভক্ত করেছিলেন। জিয়া থেকে খালেদা জিয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সামরিক যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। সেই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের শান্তিচুক্তি করা ছিল জাতিগত বিদ্বেষ দূর করার প্রচেষ্টা। সেটি এখনও কতটা বিদ্যমান তা বিতর্কের বিষয়; কিন্তু আন্তর্জাতিক মানেও যে এটি বড় বিষয় ছিল তা বলাই বাহুল্য। এর চেয়েও কম অবদান রেখে ওবামা থেকে অনেকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান, বাঙালি মানস বনাম পাকিস্তানি মানস। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও বাঙালি মানসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রাখা, জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে নিত্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ তিনি। শান্তিচুক্তি করার পর গঙ্গার পানিচুক্তিও ছিল শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের একটি বড় ধরনের সাফল্য। সীমান্ত প্রতিবেশীদের বদলানো যায় নাÑ এই সত্য মেনে সীমান্ত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি একটি বড় পদক্ষেপ। আরেকটি বিষয় হলো, অর্ধশতকের পূর্ব ধারণা থেকে বা মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে আসা। ৫০ বছর ধরে আমাদের এ-কথাই বোঝানো হয়েছে যে, ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, তাই মুসলমানদের মানে আমাদের শক্র। বাংলাদেশের অনেক মানুষ তা বিশ্বাস করতেন। তাই ভারতের সঙ্গে দুটি বিষয়ে সমঝোতা ছিল সাহসের ব্যাপার। কেননা, তা ছিল সাম্প্রদায়িকতা থেকেও বেরিয়ে আসার চেষ্টা। এ ঘটনা ঘটেছিল ১৮ বছর আগে।
খালেদা জিয়া তখনও বলেছিলেন, ফেনী থেকে খাগড়াছড়ি ভারতের হয়ে গেল। এও বলেছেন, হাসিনা ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে। একজন মহিলা, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একজন রাজনীতিবিদ হয়ে তিনি তখন থেকে যে ধরনের মিথ্যাচার করেছেন, ইসরায়েলি কোনো রাজনীতিবিদও এমন মিথ্যাচার করেন নি। এ ধরনের মিথ্যাচার রাজনীতি নয়, মানুষকে বিভ্রান্ত করাও রাজনীতি নয়। এগুলো নষ্টামি। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের এলিট সমাজের বড় অংশ, যার মধ্যে মিডিয়াও অন্তর্গত, এই নষ্টামি পছন্দ করে।
২০০১ সালের নির্বাচনে সব ডানপন্থি একত্রিত হয়ে জোর করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া অপরাধ। পত্রিকা যাদের সুশীল সমাজ বলে বা এলিটরা, যারা কথায় কথায় রক্ষীবাহিনী ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা তোলেন, সেই সব ব্যক্তি কিন্তু ঐ পাঁচ বছরের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা বেমালুম ভুলে যান। না, এটিতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাদের এসব পদক্ষেপ বরং তাদের নষ্ট চরিত্র পরিস্ফুট করছে।
ভারতের সংসদ সীমান্ত নির্ধারণ ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুমোদন করেছে। এটি বড় ধরনের বিজয়। এর সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। মিয়ানমারের সঙ্গেও এ ধরনের দুটি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে তার আমলে। গত ৭০ বছরে যার মীমাংসা করা যায়নি, তা করতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। তাই এ দুটি বিষয়ে এখানে গুরুত্ব আরোপ করব।
সীমান্ত চুক্তি বিষয়টি খুব সহজ ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত সংরক্ষণ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেন। ঐ সময় নানা বিষয়ে চুক্তি হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ছিটমহল বিনিময় ও সীমান্ত চুক্তি।
১৯৪৭ সালে রেডক্লিফ রোয়েদাদের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা ছাড় দিয়েছিল, যাতে পশ্চিমে তারা ভারতের থেকে ছাড় পায়। ১৯৪৯ সালেও আন্তর্জাতিক একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় সীমান্ত চিহ্নিতকরণ নিয়ে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান ভারত একটি চুক্তি করে সীমান্ত বিরোধ নিরসনে। উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনাও হয়নি এরপর।
বঙ্গবন্ধুর সময়ই সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও ছিটমহল নিয়ে ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হয় সেটি ছিল এসব বিরোধ নিরসনে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। ১৯৭৪ সালেই দু-পক্ষ ১৯১৫ সাল থেকে প্রণীত বিভিন্ন সেটেলমেন্ট ম্যাপ নিয়ে আলোচনায় বসে। মুজিব ইন্দিরা যে চুক্তি হয়েছিল ত্রিপুরার কাসালং মৌজার ওপর বাংলাদেশের কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়। সিলেট সীমান্তে পাথুরিয়া এবং অঙ্গুরপোতা ও দহগ্রাম ছিটমহল বাংলাদেশ লাভ করে। ভারতকে ছেড়ে দিতে হয় বেরুবাড়ি। বেরুবাড়ির অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দু, দহগ্রামে মুসলমান। এ ক’টি ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশ পায় ৩১ বর্গমাইল এলাকা। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের এতে যথেষ্ট আপত্তি ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ভারত এত বড় দেশ যে এখানে-সেখানে কিছু ভূমি চলে গেলে কিছুই আসে-যায় না। আসলে, নেতাদের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তাহলে কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়। সীমান্ত বিতর্ক নিরসনে ইন্দিরা-মুজিবের সদিচ্ছা ছিল, তাই তা সম্পন্ন হয়েছিল।
এখন যেমন, আওয়ামী লীগ কোনো অর্জন করলে বিএনপি-জামাত তা নস্যাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, সে-সময়ও একইভাবে সে-চেষ্টা করতেন মওলানা ভাসানী ও জাসদ। ভাসানী ন্যাপ ও জাসদ ঘোষণা করল, বেরুবাড়ি দিয়ে সার্বভৌমত্ব ক্ষুণœ হয়েছে। দহগ্রাম আঙ্গুরপোতার কথা তারা তোলেনি। জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকার চুক্তিটি অনুমোদন করিয়েছিল; কিন্তু ভারতীয় সংসদে তা অনুমোদন না করায় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে চুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন, বিশেষ করে তিনবিঘা করিডরের ক্ষেত্রে। দহগ্রাম ও আঙ্গুরপোতার সঙ্গে মূল ভূখ-ের যোগাযোগের জন্য ভারত তিনবিঘা পরিমাণ জমি লিজ দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশকে। জিয়া কিছুই করতে পারেন নি। এরশাদ তিনবিঘার ব্যাপারে খানিকটা অগ্রসর হয়েছিলেন; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে তিনিও ব্যর্থ হন। বরং এরশাদ আমল থেকেই ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশের আপত্তি ভারত গ্রাহ্য করেনি।
এরপর থেকে এ পর্যন্ত সীমান্ত বা ছিটমহল সমস্যা নিয়ে কোনো মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর পরের ইতিহাস আমাদের জানা। মনমোহন সিং এগিয়ে এলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে ছিটমহল ও তিস্তার পানি মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি। তবে, মমতাই সব সময় বাধা দিয়েছেন তা ঠিক নয়। পূর্ববর্তী সরকার বা সরিক দলও বাধা দিয়েছে। এখন ভারত পাবে ১১৪টি ছিটমহল বা ১৭ হাজার ১৫৮ একর আর বাংলাদেশ পাবে ৫৪টি বা ৭ হাজার ১১০ একর। এছাড়া নদী ভাঙন ও নানা কারণে সমাধান হবে ভারতের দখলে থাকা বাংলাদেশের ২ হাজার ১৫৪ একর ও বাংলাদেশের দখলে থাকা ভারতের ২ হাজার ৮৫৩ একর। সমুদ্রসীমা নিয়েও একই সমস্যা ছিল।
১৯৪৭ সালে রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী ভারত ভাগ হলেও, রোয়েদাদের বেশ কিছু এলাকা নিয়ে পরে পাকিস্তান-ভারতের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়; কিন্তু বঙ্গোপসাগর নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ পাকিস্তান সরকার নেয়নি, কেননা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। একপাশে মিয়নমার (বার্মা), অন্যপাশে ভারতেরই কর্তৃত্ব ছিল বঙ্গোপসাগরের ওপর।
পরিস্থিতির বদল হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। এ-কথা আজ সবাই ভুলে যান যে, বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রথম বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব নিরূপণে পদক্ষেপ নেয়। এবং সেই সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রায় চিড় ধরানোর উপক্রম করে এই বিরোধ।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই তৎকালীন সরকার ১৯৭৪ সালে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রকাশ করে। এর মূল কথা হলো বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্র সীমানা হবে ১২ নটিক্যাল মাইল, অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমা হবে ২০০ নটিক্যাল মাইল। আর বাংলাদেশের তটরেখা নির্দিষ্ট করা হয় ২৫.৬ থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরত্বে যেখানে গভীরতা থাকবে ১০ ফ্যাদম। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত সমুদ্রসীমা নির্ধারণের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন বাংলাদেশের উপকূলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে। সালিশি আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয় এসব যুক্তির ভিত্তি বক্তৃতায় নিহিত।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে হয়তো দু-পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছাত। কিন্তু, সে সুযোগ আর ফিরে আসেনি। উল্লেখ্য, ঐ সময় সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোনো রাজনীতি হয়নি। বাংলাদেশ চেয়েছে তার ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা হোক। ভারত চেয়েছে বঙ্গোপসাগরে তার কর্তৃত্ব থাকুক।
জিয়ার আমলে তার পররাষ্ট্রনীতিতে সমুদ্রসীমা নিরূপণ তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনিই প্রথম এর ব্যবহার করেন। তার আমলে, বিভিন্ন ফোরামে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে যে আলোচনা হয়নি, তা নয়, হয়েছে এবং তার ভিত্তি ছিল মুজিব আমলের আলোচনা। ইন্দিরা গান্ধী ফের ক্ষমতায় এলে আবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু, ভারত কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি হয়নি। এ সময়ই সৃষ্টি হয় তালপট্টি ইস্যুর।
সীমান্ত নদী হাড়িয়াভাঙ্গার মোহনায় ১৯৭০ সালের দিকে একটি চর ভেসে ওঠে। ভারত এর নাম দেয় পূর্বাশা বা নিউমুর দ্বীপ এবং এর মালিকানা দাবি করে। আরও পরে ১৯৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করে এবং বাংলাদেশ এর মালিকানা নির্ধারণে যৌথ জরিপের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কাজের কিছুই হয়নি। ১৯৮১ সালে ভারতীয় সেনা দক্ষিণ তালপট্টিতে অবতরণ করে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনমত তীব্র হয়ে ওঠে। জিয়া সরকার এর প্রতিবাদ জানায় বটে; কিন্তু কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তালপট্টি নিয়ে যখন তুঙ্গে তখন জিয়া ঘোষণা করলেন, তিনি এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবেন। আরও বললেন, বাকশালীরা বিদেশি শক্তির সাহায্যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। সরকারি মাধ্যমে এই প্রচার শুরু হলো। শুধু তাই নয়, ভারতীয় দালাল শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন এই তালপট্টি নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং ভারতের স্বার্থ দেখার জন্য। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিএনপি নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য তখন এই স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করে। এরপর জিয়া নিহত হন। এরশাদের ভাগ্য ভালো, তার শাসনামলে তালপট্টি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। এক সময় হারিয়ে যায় নিউমুর দ্বীপ। এরশাদ আমল থেকে শেখ হাসিনার পূর্ব আমল পর্যন্ত সমুদ্রসীমা নিয়ে একেবারে কোনো আলোচনা হয়নি, তা নয়। হয়েছে; কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। সরকারের কোনো মানচিত্রে এরপর তালপট্টিকে দেখানো হয়নি। তালপট্টি তো তখন হারিয়ে গেছে, মানচিত্রে দেখানো হবে কী করে?
সমুদ্রে মালিকানা পাওয়ার পূর্বে অবস্থাটা কী ছিল? ছিল পাকিস্তান আমলের মতো। মিয়ানমার ও ভারতের কর্তৃত্বেই ছিল সমুদ্রের মহীসোপান। বাংলাদেশ সরকার তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন ব্লকের কাজ শুরু করলেও ভারত-মিয়ানমারের জন্য কোনো কাজ করতে তেমনভাবে পারেনি। বিদেশি কোম্পানিগুলোও এতে উৎসাহিত হয়নি। বরং বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভারত কাজ শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বেশি দিন শাসন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি এবং বিএনপি-জামাত। তারা এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে কিছুই করতে পারেনি।
শেখ হাসিনার কৃতিত্ব এই যে, তিনি তার পিতার আরব্ধ কাজ শুরু করেছিলেন। তার কৃতিত্ব এ কারণে বেশি যে, যে দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ সে দুটি দেশকেই তিনি হেগে সালিশি আদালতে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তারা সালিশে রাজি না হলে বাংলাদেশের কিছু করার ছিল না। এই কূটনৈতিক কৃতিত্বের কথা কিন্তু অনালোচিত রয়ে গেছে।
ভারত দাবি করে ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৩৩ বর্গকিলোমিটার; যা উত্তর প্রদেশ, বাংলা ও আসামের আয়তনের সমান। এ ধরনের সংজ্ঞার কারণে বিতর্কিত জলসীমা উড়িষ্যা উপকূল থেকে অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তমের কাছে স্যান্ডি পয়েন্টের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভারতের প্রতিনিধি এতে আপত্তি উত্থাপন করেন; কিন্তু ভোটে হেরে যান। [টেলিগ্রাফ, ০৯.০৭.১৪]
টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, “৪ লাখ ৬ হাজার ৮৩৩ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ভারত পেয়েছে ৩ লাখ ২২০ বর্গকিলোমিটার এবং বাংলাদেশ ১ লাখ ৬ হাজার ৬১৩ বর্গকিলোমিটার। এ পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিকর। কারণ, ভারতকে যে ২ লাখ বর্গকিলোমিটার দেওয়া হয়েছে তা কখনোই বিতর্কিত ছিল না। আসলে বিতর্কিত এলাকা ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ১৯৭ বর্গকিলোমিটার এবং এর মধ্যে ভারত হারিয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬১৩ বর্গকিলোমিটার।”
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও লেখা হয়েছেÑ “শুনানিতে ভারতের কেবল সামন্য সান্ত¦নার জয়, সুন্দরবনের দক্ষিণে অগভীর সমুদ্র এলাকা থেকে সীমানা চিহ্নিত করার সূচানবিন্দু ধরা। এ জয়ের কারণে ভারত নিউমুর বা দক্ষিণ তালপট্টি নামে অতি ক্ষুদ্র একটি দ্বীপের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করেছে। তবে উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যায় যে, এ এলাকাটি ইতোমধ্যে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।”
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? বাংলাদেশে আগামী এক দশকে গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। এতদিন সমুদ্রে ব্লক ভাগ করেও আমরা মিয়ানমার আর ভারতের আপত্তির কারণে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে পারিনি। বাংলাদেশ ১০টি ব্লক করেছিল। ভারত বলেছিল এগুলো তাদের। এখন দেখা যাচ্ছে, সবই বাংলাদেশেরÑ মাত্র ৫টিতে ভারতের সামান্য অংশ আছে।
সমুদ্রের মৎস্য সম্পদেরও বিরাট অংশ এখন বাংলাদেশের। উন্মুক্ত সাগর ছাড়া, হাড়িয়াভাঙ্গার অর্ধেক পর্যন্ত যেতে পারবে বাংলাদেশের জেলেরা। গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা যাবে। এক কথায়, বর্তমান সরকার নতুন প্রজন্মের জন্য এ সম্পদের স্বর্ণ দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়ে গেল। এখন সম্পদ আহরণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা শুধু দরকার।
সমুদ্র জয়ের পরও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে তীব্রভাবে গালমন্দ করতে ভোলেন নি খালেদা জিয়া ও বিএনপি।

ছয়
বিএনপি’র সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং যে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, তা হলো গোলাম আজম-নিজামী বা জামাত বা ১৯৭১ সালের খুনিদের ক্ষমতায় বসানো। বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা কখনও ঘটেনি। কিন্তু তাও এলিট ও মিডিয়া দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ মেনে নিয়েছিল।
স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করা তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্র। এটি কেন গ্রহণযোগ্য হলো গণতন্ত্রের নামে? আজকে যারা নির্বাচনে গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে বলে বড় কথা বলেন, তাদের কেন তখন মনে হয়নি স্বাধীনতা বিসর্জিত হচ্ছে? এটি গণতন্ত্র নয়। এটি গণতন্ত্র হলে ইউরোপে নাজি দল অক্ষুণœ থাকত, তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া হতো। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এসব অনাচার নষ্টামি প্রশ্রয় দিয়েছে সামাজের একটি বড় অংশ। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের প্রতিও চরম অপমান। তখনও অনেক বীরবিক্রম বীরের ভঙ্গি করে ১৯৭১-এর খুনিদের সঙ্গে কোলাকুলি করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছেন। বাইরে আবার মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করতে চেয়েছেন।
এদেরই বলেছি, বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাদের কাছে নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য নিছক যুদ্ধমাত্র। অন্যান্য দেশে মানুষ চিন্তা করতে পারে না, খুনি বা মানবতাবিরোধীদের সমর্থন দূরে থাকুক, গণতন্ত্রের নামে এদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা। বাংলাদেশে তা ঘটেছে। নষ্ট মানুষ না বলে ঐসব খুনি ও তাদের সমর্থকদের সম্মান করা হয়েছে।
ঐ সময় তারা যে কাজটি করেছিল গণতন্ত্রের নামে, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে দেওয়া এবং ১৯৪৭ সালকে ১৯৭৫ সালের সঙ্গে যুক্ত করা। পাকিস্তানি মানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য আবার তারা ফিরিয়ে এনেছিল, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল অর্থাৎ হিন্দুদের দালাল অর্থাৎ ধর্মবিরোধী। এই মিথ্যা প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করেছে মোল্লা-মৌলবী নামের তথাকথিত অর্ধশিক্ষিত আলেমরাও। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ বা সেকুলারপন্থিদের দমনের জন্য ফ্রন্ট হিসেবে জঙ্গিদের সৃষ্টি করা হয়েছে সুচতুরভাবে। সরকারি উদ্যোগে বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছে। নাজি জার্মানিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটত। ঐ পাঁচ বছরে তারা যা করেছিল, তাতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা দলের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হতো। আওয়ামী লীগ বা হাসিনাকে তখন কোনো বিদেশি সরকার এমন কী ভারত সরকারও সমর্থন করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনা দলকে ধরে রেখেছিলেন, নিজেও টিকেছিলেন স্রেফ আদর্শের জোরে। অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক শাসকরাও তাকে দমাতে পারেনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জয় অনিবার্য ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত খালেদা-নিজামী মঈনের অত্যাচার ও লুটপাটে বিএনপি-জামাত সমর্থকও অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। ফলে বিএনপি-জামাতরা এমনভাবে পরাজিত হলো যে, দল হিসেবে টিকে থাকাও কষ্টসাধ্য ছিল।
শেখ হাসিনা যখন কঠোরভাবে জঙ্গি সন্ত্রাস দমন করেছেন, তখন আবার আন্তর্জাতিক সমর্থন ফিরে পেতে থাকেন। কারণ পাশ্চাত্যে এবং অনেক জায়গায় ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সংখ্যা বাড়ছিল। নিজেরা সন্ত্রাসের শিকার হওয়ায় তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল কিছুটা যে, সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল সমর্থন করা যায় না। কিন্তু নষ্ট মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এখনও সন্ত্রাসের স্থান আছে। যারা জামাতকে এখনও মডারেট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মনে করে, ২০১৩-১৪ সালের সন্ত্রাসকে সমর্থন দেয়, তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করলে যে আখেরে পস্তাতে হবে, এটি আমাদের রাজনীতিবিদ ও আমলাকুলকে অনুধাবন করতে হবে।
জঙ্গিবাদ নির্মূল ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বর্তমান সরকার শুরু করেছিল। শেখ হাসিনা দলের ও সরকারের নেতৃত্বে না থাকলে এ বিচার যে হতো না, এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই নিশ্চিত। এটি একটি আদর্শগত অবস্থান। একই সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও যে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো সংবিধানে সংযোজন করেছেন, তাও একটি অর্জন।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় না গেলে যে রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তগুলো নিতে পেরেছেন শেখ হাসিনাÑ তা কি সম্ভব হতো? পদ্মাসেতু নিয়ে যে কা- হলো তা ছিল সুপার পাওয়াররা, যা চায় দুর্বল দেশ তা মেনে নেবে কি নেবে না তার পরীক্ষা। এই দ্বন্দ্বে আমরা জিততে না পারলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হতো না। কিন্তু শেখ হাসিনা সে সাহস দেখিয়েছিলেন। ১৯৭১-৭২ সালে সে সাহস দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ। হ্যাঁ, তার ফল প্রথমোক্ত দুজন ভোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডিকটাট শেখ হাসিনা মানেন নি, এটি যুক্তরাষ্ট্রের এস্টাবলিশমেন্ট কখনও ভুলবে না। তারা প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেন নি। শুধু তাই নয়, নিজ অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরির উদ্যোগ ও বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে চীনের নেতৃত্ব যে ব্যাংক গড়ে উঠছে, তাতে যুক্ত হওয়া সাহস ও প্রজ্ঞার ব্যাপার। কারণ এ শতাব্দী হবে এশিয়ার। ইউরোপ বা আমেরিকার নয়।

সাত
এলেন, দেখলেন, জয় করলেনÑ এ ভাগ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু বা তার কন্যা জন্মগ্রহণ করেন নি। এ রাষ্ট্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আত্মত্যাগ শুধু নয়, রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার দল ও বিরোধীদের থেকে। এবং নিজ (পরিবারেরও) প্রাণ দিয়ে তিনি তার মূল্যও দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন তার নিকটজন কেউ এদেশে ছিলেন না স্বামী ছাড়া। বিশ্বাস করার মতো লোকও ছিল না। জেনারেল জিয়া তাকে দেশে আসতে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরশাদ পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। সেই আমল থেকে এ পর্যন্ত তাকে বারবার মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছে। এরশাদ আমলে প্রথম তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এরশাদ পুলিশের সাহায্যে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেন। ঐ দিন সেখানে আট-দলের এক সমাবেশ ছিল। মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে যাচ্ছিলেন। বিনা উসকানিতে পুলিশ, আর্মড পুলিশ আর বিডিআর মিছিলের ওপর গুলি চালায়। ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন, আহত হন ৫৬ জন। ঐ ৫৬ জনের পরে আরও অনেকের মৃত্যু হয়। এটি চট্টগ্রাম হত্যাকা- নামে পরিচিত। এ নিয়ে মামলা হয়েছিল। সে-মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। হবে কি না সন্দেহ।
খালেদা জিয়া এবং খালেদা জিয়া ও নিজামীর আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালানো হয়। এতবার চেষ্টা হয়েছে যে তার সংখ্যা আর মনে নেই। সবচেয়ে বড় চেষ্টা ছিল টুঙ্গিপাড়া ও গুলিস্তানে। গুলিস্তানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য খালেদা ও তার পরিবার এবং গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি জড়িত ছিল। তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। মৃত্যু হয়েছে অনেকের। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। কোনো মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। এটি গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাপার নয়।
শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় থেকেছেন, ততবারই তাকে অজস্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এদেশের সামরিক, বেসামরিক আমলাকুলের এবং এলিটদের আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি গোপন একটি বিদ্বেষ ভাব আছে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন তাকে বেশি হতে হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বিডিআর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। তারপর খালেদা-নিজামীর জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাসের রাজনীতি। হেফাজতের ঢাকা দখল চেষ্টা। মিডিয়ার বিরুদ্ধাচরণ। আন্তর্জাতিকভাবে বিরুদ্ধাচরণ। সব প্রতিকূলতা তিনি মোকাবিলা করেছেন। এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আবার পুনর্¯’াপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু এই রাষ্ট্র গঠন ও তার কাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, তার কন্যা তা দৃঢ় করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, গত প্রায় ৫০ বছরে শেখ হাসিনার সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি কি শুধু শুধু, না সঠিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ ও প্রণোদনার কারণে। বাংলাদেশ এখন যত সমৃদ্ধ গত ৫০০ বছরে তত সমৃদ্ধ ছিল না। খুব শিগগিরই তা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। এটিও ভেবে দেখা দরকার, কেন সামরিক এবং বাংলাদেশ-বিরোধীদের বা পাকিস্তানি-বাঙালিদের আমলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতির পথে এগিয়ে গেলেও এখনও তার পথ কুসুমান্তীর্ণ নয়; বরং বড় বেশি কণ্টকাকীর্ণ, বিপদসংকুুল।
স্বদেশে, প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে ও হচ্ছে। একদিকে বিএনপি-জামাতের মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতা ও প্রবল বিরোধিতা; অন্যদিকে প্রশাসন ও বিভিন্ন দল, গ্রুপ ও ব্যক্তির পাকিস্তানি ও হেজাবি মনোভাবÑ এসবই মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাকে। এর পাশাপাশি সচল রাখতে হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ঘরে-বাইরে শত বাধা-বিঘœ, শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কিন্তু এই রাষ্ট্র গঠন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এ রাষ্ট্র যখন তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছিল এবং রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা সেই রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে এনেছেন অনেকটা এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র থেকে তা সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রে পরিণত করার কৃতিত্বও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মতৈক্য হয়েছে। তাই বলে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। সাফল্য ও অর্জন যেন তাকে আচ্ছন্ন না করে। আগামীতে তাকে আরও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, নিরন্তর।
শেখ হাসিনার বিভিন্ন কার্যক্রমের আমরা সমালোচনা করতে পারি, তার অনেক কার্যক্রম আমাদের মনঃপূত নাও হতে পারে; কিন্তু তিনি ফিরে এসে যা করেছেন তাতে ইতিবাচক দিকের সংখ্যাই বেশি। তার পিতা আজন্ম সামরিক বা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধ লড়াই করেছেন। তিনিও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন এবং সৈন্যরা যাতে উচ্চাকাক্সক্ষী না হয় সে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন, যার একটি ধারায় আছে যিনি বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করবেন, তিনি ক্ষমতাচ্যুত যখন হবেন (হতেই হবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যই তা) তখন তাকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাস দমনের কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপের দরুণ বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নারী উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ অনেকটা রোল মডেলের অভিধা পেয়েছে। বাংলাদেশকে এখন উপেক্ষা করা যায় না। তিনি দেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংরক্ষণ করেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব প্রায় ফিরিয়ে আনছেন। তিনি সাধারণ মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশের এখন বিদেশি সাহায্য না পেলেও চলবে, মুখ থুবড়ে পড়বে না। আলু থেকে জাহাজ সব কিছুই রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশে মঙ্গা নেই। দারিদ্র্যের হার কমছে। দারিদ্র্য আছে; কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়ে বাংলাদেশে আর কারও মৃত্যু হবে কি না সন্দেহ। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, সেদিকে তাকাই সেদিকেই উন্নয়ন আর উন্নয়ন। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পাবে, উন্নয়ন যত অগ্রগতি পাবে। রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকীকরণ তিনি প্রতিরোধ করেছেন। এজন্য তাকে নিত্য লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে পাকিস্তানি বাঙালি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন জিয়াউর রহমান। সেই ক্ষতি ও সেই ক্ষত থেকে পাকিস্তানি মানসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তা এখনও শেষ হয়নি। সেটি চালাতে হবে অবিরাম, চলবে। রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার রাজনীতি বা বাঙালিত্বের লড়াইয়ের বিষয়টা নতুন জেনারেশনের মনে প্রোথিত করতে হবে। মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে।
বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন। সামরিক শাসক ও বিএনপি-জামাত বাংলাদেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তিনি এখন বাংলাদেশকে সবল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমি যা বর্ণনা করলাম তা হলো একটি সংক্ষিপ্তসার মাত্র। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ বা সরকারপ্রধানের এত অর্জন বা সাফল্য নেই। তার আরও অনেক করার আছেÑ তাই নিত্য লড়াই করে যেতে হবে তাকেÑ এই কামনাই করি।
আগেও বলেছি, আবার বলছিÑ তার অনেক সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলেও আমরা বাঙালিত্ব দর্শনে বিশ্বাসী এবং সে-কারণে তার নেতৃত্বে আস্থাশীল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তিনি করছেন, এ কারণেও তার প্রতি আমরা যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি তারা কৃতজ্ঞ। যারা বিশ্বাসী নয়, বিশেষ করে গত প্রজন্ম, তাদের যতই এ বিষয়ে জ্ঞানদান করা হোক না কেন, তাদের আর বিশ্বাসী করা যাবে না। নষ্টদের বিরুদ্ধে শুরু করেছেন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন, আরও পথ পেরুতে হবে। তার এই যাত্রায় আমরা আছি তার সঙ্গে। নষ্টদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, পাকিস্তানি বাঙালিদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, তারা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। আশা করি আওয়ামী লীগ এ ধারা বজায় রাখবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতা
পরবর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য