রামেন্দু মজুমদার : ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল, ১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর তার নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ হলো, ১৯৭৫-এ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ হয়ে, ১৯৭৬-এ পুনরুজ্জীবিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ ২০২০-এ দেশের সর্ববৃহৎ প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হাসিলের পরপরই দেশে যে ধর্মীয় উন্মাদনা বইছিল, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিরোধী দল গঠনে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন প্রতিষ্ঠাতারা, যখন তারা বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানে বাঙালির স্বার্থ রক্ষা হবে না, মুসলিম লীগে বাঙালির মুক্তি নেই।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
“সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন শোষণ করতে চায় তখন তারা আঘাত করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর, ভাষার উপর। তাকে ধ্বংস করতে না পারলে শোষণ করা সহজ হয়ে উঠে না। তাই ১৯৪৮ সালের পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানল। সংখ্যাগুরু লোকের ভাষার উপর আঘাত করে আমাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হলো। তখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল মুসলিম লীগ। জিন্নাহ সাহেব তখন বেঁচে আছেন এবং তাঁর দলের লোকেরাই বাংলাদেশে শাসন চালিয়েছিল। তাদের শক্তি ছিল, সামর্থ্য ছিল, অর্থ ছিল । বিদেশী শক্তিও তাদের পিছনে ছিল। আমরা ভাষার উপর এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারই ফলশ্রুতিতে আটচল্লিশ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। ঐ তারিখেই অন্যান্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে আমরা শোষকগোষ্ঠীর আঘাতের মোকাবেলা করি।”
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। এ ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি। আমাদের ভাষার অধিকার অর্জনের পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিÑ এ তো সবাই জানে।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে প্রগতিশীল যুবকদের এক সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ গঠন করা হয়। সেই সম্মেলনেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যে : “পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।” উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের গু-ারা সম্মেলন প- করার জন্য হামলা চালালে শেখ মুজিবও আহত হন; কিন্তু মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ভাষা আন্দোলনের দুটি পর্ব। প্রথমটির সূচনা ১৯৪৮-এ আর দ্বিতীয়টির ১৯৫২-তে, যার মাধ্যমে আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার অধিবেশনে কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। মুসলিম লীগের বাঙালি সদস্যরা-সহ সবাই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এ-সময়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে ঐ দিন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
তখনকার সচিবালয় ইডেন বিল্ডিং এলাকায় পিকেটিং করার দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখের ওপর। ব্যাপক লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এতে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে সম্পাদিত চুক্তির পর ১৫ মার্চ গ্রেফতারকৃতরা মুক্তি লাভ করেন। ২৪ মার্চ গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়, তবে ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের ইতি ঘটে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন আজ আমাদের গৌরবের ইতিহাস। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি হন। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন। সেখানে থেকেই কীভাবে তিনি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তার উল্লেখ আছে :
“আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছে। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরও দু-একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।”
এ প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম এ কারণেই যে, কেউ কেউ ইতিহাস বিকৃত করে বলেন যে, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে বন্দী শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা নেই।
আজ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেমন সমার্থক, তেমনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো সুযোগ নেই।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হবার সাথে সাথেই নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে যে ২১-দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল, তার অন্যতম ‘বাংলা ভাষার গবেষণাগার’ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসেই এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা প্রবর্তন করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা বাতিল করে। স্বাভাবিকভাবে নতুন প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের উদ্যোগও থেমে যায়। যখন ৩ জুন ১৯৫৫ আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে তখন নতুন সরকারের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ আগ্রহে ২৬ নভেম্বর ১৯৫৫ যুক্তফ্রন্ট সরকার ‘বাংলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৩ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ৬৫ বছরে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনার এক মর্যাদাপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদে একটি আধুনিক চলচ্চিত্র স্টুডিও স্থাপনের বিল উত্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। এদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে সূচিত হলো এক নব দিগন্ত।
আওয়ামী লীগের শেকড় বাংলার সংস্কৃতিতে প্রোথিত। তাই তো দেখি ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সংগীতশিল্পী সমাজের দেওয়া এক সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন :
“দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সংগীতে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখকে প্রতিফলিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।
আপনারা ভালবাসা এবং শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের জন্যে গান রচনার দিন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে হবে। মানুষের মনে প্রেরণা যোগাতে হবে। যদি এতে বাধা আসে, সেই বাধা মুক্তির জন্যে সাত কোটি বাঙালি এগিয়ে আসবে। একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা। বাংলার মানুষ মুসলমান নয়, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নাইÑ এই ধরনের অভিযোগ দিয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে ২৩ বছর ধরে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। আর বাংলার মানুষও এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন।
জনগণ যখন অধিকার আদায়ের জন্যে সংগ্রাম করছিল, তখন এক শ্রেণীর শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি গত ২৩ বছরে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশস্তি গেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গুছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা কি আজ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন? কোন্ ৪০ জন ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন? কোন্ বিশেষ মহল তথাকথিত ইসলামের নামে নজরুলের গান ও কবিতার শব্দ বদলেছে? রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বটা থাকে কোথায়?”
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি রাখল। যথাযথ একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তদানীন্তন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার লক্ষে একটি বিল উত্থাপিত হবার পর তা গৃহীত হয় এবং পরদিন তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। আজ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি জেলার গ-ি ছাড়িয়ে উপজেলা পর্যন্ত বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের প্রধান লক্ষ্য তখনই অর্জিত হবে যখন একাডেমি অনুষ্ঠান নির্ভরতা কমিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে শিল্পকলার অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশিক্ষণ ও চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সাথে বঙ্গবন্ধুর ছিল অত্যন্ত প্রীতির সম্পর্ক। তারই পরামর্শে বাংলাদেশের লোকশিল্প ও লোকজ ঐতিহ্য বিকাশের লক্ষে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, প্রাচীন বাংলার এক সময়ের রাজধানী সোনারগাঁওকে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সভাপতি করে আওয়ামী লীগ সরকার ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ প্রচেষ্টায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তার জন্মদিনের আগের দিন ২৪ মে ১৯৭২ কবি পরিবারসহ একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা আনা হয়। ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি নির্ধারিত হয় কবির বসবাসের জন্যে। সে বাড়ির মুক্ত পরিবেশে কবিকে উৎফুল্ল দেখায়। বিদ্রোহী কবির সাথে রাজনীতির কবির দুর্লভ মিলন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক গৌরবের অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর আমলেই বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলন উদ্বোধন করেন। তারই ইচ্ছায় তার সাথে মঞ্চে ছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও বোস অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী।
যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু নাট্যমঞ্চায়নের একটা বড় প্রতিবন্ধকতা দূর করেছিলেন, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা। ২১ মে ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু রামপুরায় নতুন টেলিভিশন ভবন পরিদর্শনে গেছেন। অভ্যর্থনাকারীদের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তরুণ প্রযোজক আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু দু-হাত মামুনের গালে ধরে আদর করে জিগ্যেস করলেন, কী, তোমাদের নাটক কেমন চলছে? সে-সময়ে কিন্তু প্রমোদ কর ও সেন্সরশিপের আইন কড়াকাড়িভাবে প্রয়োগ করার ফলে ঢাকায় নিয়মিত নাট্যচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামুন জবাব দিল, আপনি তো নাটক বন্ধ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কারণ জানতে চাইলে মামুন এ দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করল। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক। তাকে বঙ্গবন্ধু বললেন, কী মল্লিক সাহেব, নাটকের লোকেদের কাছ থেকে টাকা না নিলে কি আমার সরকার চলবে না? বঙ্গবন্ধু পরদিনই মামুনকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি আর মামুন সে অনুযায়ী গণভবনে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের বন্ধু ড. ফরাসউদ্দীন ছিলেন তখন রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব। ফরাস ভাইকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বললেন, অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করে দাও যে এখন থেকে সৌখিন নাট্যদলগুলোকে কোনো প্রমোদ কর দিতে হবে না আর সেন্সর পুলিশের বদলে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি নাটক সেন্সর কমিটির মাধ্যমে হবে। মন্ত্রণালয়ে পাঠালে জটিলতা হতে পারে উল্লেখ করে সরাসরি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির কথা বললেন। তারপরই নাট্যচর্চার ওপর থেকে প্রমোদ কর উঠে গেল এবং নাটকের সেন্সর পদ্ধতি সহজতর হলো। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা নাটকের সেন্সর আইন পুরোপুরি বাতিল করেন। যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছেন তারা নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার জন্যে, বাঙালি সংস্কৃতির জন্যে বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগের অনেক কথা বলতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য বিশ^-স্বীকৃতি অর্জন করেছিল আর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় প্রদত্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুখের কথা, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশে সমভাবে আগ্রহী।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আমাদের শহিদ দিবসের এই বিশ্ব-স্বীকৃতিতে শেখ হাসিনার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটÑ যেখানে কেবল বাংলা নয়, পৃথিবীর সব ভাষা নিয়ে গবেষণার ব্যবস্থা রয়েছে। এর সংগ্রহশালায় সব ভাষার লিপির নমুনা তুলে ধরা হচ্ছে। আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কয়েকটি ভাষায় শিশুরা যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করতে পারে, তারও ব্যবস্থা সরকার করেছে।
২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমির অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্নœ জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার উদ্বোধনের মাধ্যমে নাট্যশালা ভবনের উদ্বোধন করেন।
গ্রন্থপ্রেমী ও সুলেখক শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত ১৭ বার বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করে আমাদের প্রকাশনা শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার করেছেন। বাংলা একাডেমির সব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ যোগান দেওয়ার ফলে একাডেমি গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে নতুন নতুন কাজ করতে পেরেছে।
গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট। এখনও তার নিজস্ব ভবন তৈরি না হলেও এ ইনস্টিটিউট থেকে বিভিন্ন মেয়াদি কোর্স পরিচালনা করা হচ্ছে।
সংস্কৃতিসেবীদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়েই আন্তরিক। অগণিত শিল্পী-সাহিত্যিককে উদার হাতে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টÑ যাতে এ সহায়তা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে করা সম্ভব হয়।
সংস্কৃতির বাজেট ক্রমাগত বেড়েছে; কিন্তু এখনও সবচেয়ে কম বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোর ভেতরেই রয়ে গেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আমাদের দাবি বাজেটের অন্তত ১ শতাংশ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হোক।
আওয়ামী লীগের কাছে সংস্কৃতিজনদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। কারণ দলটিকে আমরা সংস্কৃতি সচেতন ও সংস্কৃতিবান্ধব বলে মনে করি। তাই আগামী দিনগুলোতে সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে দেশের উন্নয়ন হবেÑ এটাই প্রত্যাশা। বাংলাদেশের সংস্কৃতিই হতে পারে বাংলাদেশের মুখচ্ছবি।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব