Wednesday, October 4, 2023

আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু

তোফায়েল আহমেদ: আজ জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক এক শুভদিন, আওয়ামী লীগের জন্মদিন। ৭১ বছর আগের এই দিনে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে সূচিত হয় গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের। প্রতি বছর দিনটি দেশজুড়ে সগৌরবে পালিত হয়। কিন্তু এবার ‘করোনাভাইরাস’ তথা ‘কোভিড-১৯’ মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সতর্কতার অংশ হিসেবে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ’ তথা ‘মুজিববর্ষ’, ‘গণহত্যা দিবস’, ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘বাংলা নববর্ষ’, ‘মুজিবনগর দিবস’, ‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ এবং ‘৬-দফা দিবস’ পালন উপলক্ষে গৃহীত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় অনুষ্ঠানাদি সীমিতকরণ বা স্থগিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা করি, সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশাবলি সরকার অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করবে এবং দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-সহ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও এর সর্বোচ্চ স্তর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগঠিত করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘আওয়ামী লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশ’ এতটাই গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে যে, নামগুলো পরস্পর সমার্থক হয়ে উঠেছে। ‘আওয়ামী লীগ’ ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল। ’৫৩-এর ৩ জুলাই দলের কাউন্সিল অধিবেশনে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন প্রতিরোধ প্রচেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।”
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সাহেব একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থলে একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠনের কথা লিপিবদ্ধ করে যে প্রতারণা করেন, তা-ই মূলত তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে নূতন দল গঠনের নৈতিক ভিত্তি যুগিয়েছিল। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের কতিপয় প্রগতিশীল তরুণ সদস্য বিক্ষুব্ধ হয়ে ’৪৭-এর সেপ্টেম্বরে সব দলের কর্মীদের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু রচিত দুটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অমূল্য এই গ্রন্থদ্বয় সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আমরা কৃতজ্ঞ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “কনফারেন্স শুরু হল।… প্রথম অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে সাবজেক্ট কমিটি গঠন হল। আমাকেও কমিটিতে রাখা হল। আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে। তারা তাদের মতামতও প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে ঠিক হল, একটা যুব-প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে, যে কোন দলের লোক এতে যোগদান করতে পারবে। তবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে যতখানি দূরে রাখা যায় তার চেষ্টা করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচী হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করেÑ যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা।” [পৃষ্ঠা-৮৩-৮৫]। গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের উদ্যোগ ছিল মুসলিম লীগের বিপরীতে সংগঠন গড়ে তোলার প্রথম প্রচেষ্টা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই উদ্দেশে ’৪৮-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০নং মোগলটুলিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘গণবিচ্ছিন্ন নেতৃত্বের স্থলে জনসম্পৃক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা’ করে গণমানুষের অসাম্প্রদায়িক দল গঠন। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি তিনি ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ছাত্রলীগ’ ও ‘আওয়ামী লীগ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মহান ভাষা আন্দোলন ও মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল। ’৪৮-এর ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করে পিকেটিং করতে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু আহত হন, সহযোদ্ধাদের সাথে কারাবরণ করেন। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।… সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯১-৯২]। সেদিন কারারুদ্ধ অবস্থায় স্কুলের ছাত্রীদের মিছিলের সেøাগান শুনে সহযোদ্ধা শামসুল হক সাহেবকে আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৫]। কিছুকাল পরই তার সেদিনের কথার সারবত্তা প্রমাণিত হয়। নেতৃবৃন্দ সেদিন আন্দোলন করে প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে’ দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছিলেন। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির আগে, ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। ’৪৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম সংগঠিত করার কারণে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে কারারুদ্ধ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে শর্ত দেওয়া হয় যে, যদি তিনি বন্ড দিতে সম্মত থাকেন তবে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু অন্যায় সিদ্ধান্তের কাছে নতি স্বীকার করেন নি।
রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম সম্পর্কে কারারুদ্ধ থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দী’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২০-১২১]। নেতাকর্মী ও জনতার শক্তিতে আস্থাবান বঙ্গবন্ধু প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। একই বছরের ১১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ খাদ্য আন্দোলন সংগঠিত করে ও বঙ্গবন্ধু জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে ‘ভুখা মিছিল’ বের করলে সরকার বঙ্গবন্ধুসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। ’৫০-এর ফেব্রুয়ারিতে বরিশালসহ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি উসকানিতে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ’৫৩-এর ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারীর রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গণতান্ত্রিক শক্তিকে সাময়িকভাবে দুর্বল করিলেও গণতান্ত্রিক শক্তি বুঝিয়াছে যে গণ-আন্দোলনকে ব্যাহত করিবার ইহা গণদুশমনদের একটি হাতিয়ার মাত্র; আর তাদের এই হাতিয়ারকে ধ্বংস করিয়া দিতে হইবে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়া। মানুষের এই চেতনাই ১৯৫০ সালের দাঙ্গার শিক্ষা।” প্রতিষ্ঠাকালে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ব্যাপক ভূমি সংস্কার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। ভূমি সংস্কার কর্মসূচির ৯টি দফার প্রথম দফাতেই ছিল ‘জমির উপর সর্ব্বপ্রকার কায়েমী স্বার্থ ও জমিদারীপ্রথা অবিলম্বে বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করিতে হইবে।’ দ্বিতীয় দফাতে, ‘সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযোগী অকর্ষিত জমি কৃষক মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে।’ অর্থাৎ ‘বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদ’, ‘লাঙ্গল যার জমি তার ভিত্তিতে ভূমি বণ্টন’ কর্মসূচি গ্রহণ করে, বাংলার কৃষককে জমিদারি প্রথার শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঁচাতে ’৫০-এ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ও দাবিতে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণীত হয়। ভূমি সংস্কার ও কৃষকের মঙ্গলের জন্য বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন কারারুদ্ধ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি জাগ্রত ছাত্র-সমাজ কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কর্মসূচির সাথে কারাগারে থেকেই তিনি একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন করেন। তিনি লিখেছেন, “মাতৃভাষার অপমান কোন জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালীরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালীর এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮]। ’৫৩-এর ১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিলে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ২১-দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ’৫৪-তে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন ও নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জনে (২৩৭টি মুসলিম আসনের ২২২টিতে জয়ী) আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রদান করে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বঙ্গবন্ধু ১৫ মে সমবায়, ঋণ ও গ্রামীণ পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত ও বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করে। ’৫৫-এর জুনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই বছরের ২৫ আগস্ট করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন, “স্যার, আপনি দেখবেন যে, ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে ‘বাংলা’ নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ওই নাম পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না!” (ঝঢ়ববপযবং ড়ভ ঝযবরশয গঁলরন রহ চধশরংঃধহ চধৎষরধসবহঃ). বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বক্তৃতায় প্রিয় মাতৃভূমির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ ও বাংলার মানুষের প্রতি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। ’৫৫-এর ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ৯২(ক) ধারা জারিতে দলের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সবচাইতে বেশী মূল্য দিতে হল আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগের প্রায় বারশত কর্মী ও নেতা এবং প্রায় ত্রিশ জন পরিষদ সদস্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হল। আপনাদের সাধারণ সম্পাদককে বন্দী করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হল এবং ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সম্মুখে সংঘটিত এক ঘটনাকে অবলম্বন করে তার বিরুদ্ধে দাঙ্গার ও ডাকাতির অভিযোগে এক মিথ্যা মামলা রুজু করা হল।” সেই কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সর্বধর্মের-সর্ববর্ণের-সর্বশ্রেণীর মানুষের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলের নামে ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা সম্পর্কে রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিরাজমান পরিস্থিতির প্রয়োজনে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় তখন আমাদের সংগঠনটিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের রূপ দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানী জনগণের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মুসলিম লীগ ইসলামকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্বীয় ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে। এছাড়া মুসলিম লীগ যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে তা থেকে জনগণ তখনো সম্পূর্ণরূপে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে যদিও আমাদের সংগঠনটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ দেওয়া সম্ভব ছিল, তথাপি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হতো।” সেদিনের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “বন্ধুগণ, আওয়ামী লীগ জন্ম হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও উহার কর্ম্মীগণ একদিনের জন্যও স্বস্তির নির্দেশ ফেলতে পারেনি। সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মুসলিম লীগ সরকারের নূতন নূতন হামলার বিরুদ্ধে দুর্জয় সাহস নিয়ে আওয়ামী লীগকে প্রতিদিন মোকাবেলা করতে হয়েছে।” ’৫৬-তে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সে-সময় বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে ২১-দফার ১নং দফা অনুযায়ী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া; ১৭নং দফা অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শহিদদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ শহিদ মিনার নির্মাণ; বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারেÑ আজকের বাংলা একাডেমিÑ পরিণত করা ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ’৫৭-এর ৮ আগস্ট মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তার কাছে দলের দায়িত্ব মন্ত্রিত্বের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
’৫৮-এর ৭ অক্টোবর মধ্যরাতে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং রাজনীতিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন। একই বছরের ১২ অক্টোবর একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। স্বৈরশাসকের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া। ১৪ মাস কারারুদ্ধ থাকার পর মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ’৬০-এর ৭ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ’৬২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ২ জুন সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হলে ১৮ জুন তিনি মুক্তি পান। যখন রাজনীতিকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে আইয়ুব খান জেল-জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে, তখন ৫ জুলাই আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের কঠোর সমালোচনা করে দুঃসাহসী বক্তৃতা প্রদান করেন। সে-সময় যখন আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কারও কথা বলার সাহস ছিল না, তখন ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত করেছে আওয়ামী লীগ। ’৬২-তে আমাদের সেøাগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। এই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান এবং সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ গঠন করেন। অক্টোবরে দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক শাসনবিরোধী জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাবাংলা সফর করেন। ’৬৩-তে সোহরাওয়ার্দী সাহেব চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে পরামর্শের জন্য সেখানে গমন করেন। ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু নেতার এই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেন নি। ’৬৪-এর ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় ‘প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে সংসদীয় সরকার কায়েম’ ও ‘রাজনৈতিক অধিকার’ আদায়ের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সময় দেশজুড়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠিত হয়। দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও।” সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশবাসী দাঙ্গাবাজদের রুখে দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণে সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি টের পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় এক বছরের দ-াদেশ প্রদান করে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি মুক্তিলাভ করেন।


’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সম্বলিত বাঙালির ‘মুক্তিসনদ’ খ্যাত ঐতিহাসিক ‘ছয়-দফা দাবী’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সভার সভাপতি ‘ছয়-দফা’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ও ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৬-দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ৬-দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট ‘উপ-কমিটি’ গঠন এবং তারই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবী : ছয়-দফা কর্মসূচী’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। ’৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন। যা ’৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “ছয়-দফার প্রশ্নে কোনো আপোষ নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়Ñ এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয়-দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয়-দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয়-দফা হচ্ছে বাঙালীর মুক্তি সনদ।” ৬-দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলতেন “সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাবো।” কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়–ন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয়-দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।” ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে ভাষণদান শেষে রাত ১টায় বঙ্গবন্ধু যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ‘ক’ ধারা বলে তাকে সহ তার ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ৬-দফা দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতন চালায়। সামরিক সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ৬-দফার প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ’৬৬-এর ৬ জুন ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দীদের মুক্তি চাইবে। ছয়-দফা সমর্থন করবে।” [পৃষ্ঠা-৬৭]। বাংলার মানুষের প্রতি অসীম আস্থা থেকেই তিনি কথাগুলো লিখেছেন। সত্যিই ৭ই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। ৭ই জুন সফল হরতাল পালিত হওয়ার পর স্বীয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, “১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়Ñ এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯]।
৬-দফা দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ সামরিক শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা মামলার আসামি করে তাকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করে। জাগ্রত ছাত্র-সমাজ সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ৬-দফাকে হুবহু ১১-দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিউর, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহা-সহ নাম না-জানা অসংখ্য শহিদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এ প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে জাতির জনককে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্ত করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে। তখন আমাদের সেøাগান ছিল ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। জাতির জনককে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন) ও প্রাদেশিক পরিষদে (৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন) ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু বলতেন, “এই নির্বাচন ৬-দফার পক্ষে গণভোট।” সামরিক শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র করবে এটা জেনেই ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ’৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বঙ্গবন্ধু। নিজেই শপথ গ্রহণ করান। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “৬-দফা ও ১১-দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেসব ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করতে ’৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহিদ মিনারের পবিত্র বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না। চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। জননী জন্মভূমির বীর শহীদদের স্মরণে শপথ নিয়ে বলছি যে, রক্ত দিয়ে হলেও বাংলার স্বাধিকার আদায় করবো। যে ষড়যন্ত্রকারী দুশমনের দল ১৯৫২ সাল হতে শুরু করে বারবার বাংলার ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিককে হত্যা করেছে। যারা ২৩ বছর ধরে বাঙালীর রক্ত-মাংস শুষে খেয়েছে, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন বানচালের জন্য, বাঙালীদের চিরতরে গোলাম করে রাখার জন্য তারা আজও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। শহীদের আত্মা আজ বাংলার ঘরে ঘরে ফরিয়াদ করে ফিরছে, বলছে, বাঙালী তুমি কাপুরুষ হইও না। স্বাধিকার আদায় করো। আমিও আজ এই শহীদ বেদী হতে বাংলার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রস্তুত হও, দরকার হয় রক্ত দিব। কিন্তু স্বাধিকারের দাবীর প্রশ্নে কোন আপোষ নাই।” যখন ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়, তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় ১-দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বর্তমানে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃত অতুলনীয় এই বক্তৃতাই ছিল মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাতিয়ার তুলে নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমির বীর সন্তানেরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ করাতাম এই বলে যে, “বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদার মুক্ত করতে না পারবো, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।” ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক শহিদ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়! সেদিন দেশ শত্রুমুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানতাম না। যেদিন ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সংবাদ পেলাম সেদিন সারাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন মনে হয়েছে আজ আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। এরপর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই। রাস্তা-ঘাট-পুল-কালভার্ট, রেল, প্লেন, স্টিমার কিছুই নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেন। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৭-৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র সাত মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর গণপরিষদ ভেঙে জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের দিনগুলির কথা। বিশ্বসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের পরমমিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন। তারপর ১ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন যুগিয়েছিল। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সকল নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ছয়জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দু’নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো। আর প্রয়াত চারজন নেতা ছিলেন মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ন, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের প-িত জওহরলাল নেহরু। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” ’৭৩-এর ৯ অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে যান। জাপান সফরের মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়, তা আজও অটুট রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে জাপান। ’৭৪-এর ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলীয় গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী সভাপতির পদ থেকে সরে যান, তদস্থলে নির্বাচিত হন জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান। ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যেদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দু-পার্শ্বে দাঁড়িয়ে সেøাগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে এই সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমন কী যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত হয়েছিল। বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।” জাতিসংঘে ভাষণ প্রদানের পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের সাথে বৈঠক করেন। এরপর ১ অক্টোবর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ছয় দিনের সফরে ’৭৪-এর ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ইরাকের রাজধানী বাগদাদে পৌঁছান। সেখানেও রাষ্ট্রপ্রধানসহ সকলেই বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। আমরা বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাজার জিয়ারতকালে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুকে মাজারের গিলাফ উপহার দেন। ’৭৫-এর ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত জ্যামাইকার কিংস্টনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তার সরব উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর ও প্রশংসনীয় নেতৃত্ব। আজকে যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু ’৭৫-এ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকা-কে পরিচালিত করেছেন দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। ’৭৪-’৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়, যা ’৭৩-’৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতির পিতা বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশটাকে যে মুহূর্তে স্বাভাবিক করেছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেইমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ওই সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস অবিরাম পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে এ কথাই মনে করি যে, সারাটি জীবন তিনি জেল-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সবই সহ্য করেছেন আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার জন্য। দলের কর্মীদের তিনি পরিবারের সদস্য মনে করতেন। আওয়ামী লীগের জন্মকালে বঙ্গবন্ধু দলের দপ্তরেই থাকতেন। সেখানেই তার অতলান্ত কর্মব্যস্ততা এবং আহার-নিদ্রা-বিশ্রাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যখন তিনি কারাগারে বন্দী তখন বই পড়েছেন, বাগান করেছেন, অন্যান্য কয়েদিদের জীবনের করুণ কাহিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনেছেন, আবার উত্তরপ্রজন্মের জন্য সেসব কথা ও কাহিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। দেশের মানুষকে তিনি হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছেন। তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কোনো রক্তচক্ষুকেই তিনি পরোয়া করেন নি। তার দক্ষতা, সাহস, সীমাহীন ত্যাগ, অসীম ধৈর্য আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। জীবনের যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২টি মূল্যবান দিন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে শহিদের রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক মুক্তিরÑ যে অর্থনৈতিক মুক্তি বঙ্গবন্ধু সমাপ্ত করতে পারেন নিÑ দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশকে আজ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ষড়যন্ত্র শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে এদেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার। প্রায় দুই যুগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ’৯৬-এর ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। উন্নয়ন আর অগ্রগতির লক্ষ্যে গঠিত আমাদের সরকারের বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করায় শিল্পন্নোয়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকারের পাঁচ বছরের কালপর্বে দ্রব্যমূল্য ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় মধ্যে। এই সরকারের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাফল্য ’৯৭-এর ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। আওয়ামী লীগ সরকারের সফল কূটনীতির ফলে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশের দীর্ঘদিনের গঙ্গার পানি বণ্টন সংকটের সমাধান হয়। এ কালপর্বে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। জাতির জনককে হত্যার পর ঘাতকচক্র পবিত্র সংবিধান কলঙ্কিত করে হত্যাকারীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। যে কারণে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের বিচার হয়নি। বরং খুনিরা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পদ, বিশেষ সুযোগ। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। নিম্ন আদালতে হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়াতে শুরু করে। প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশে উন্নীত এবং মুদ্রাস্ফীতি ১.৪৯ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভবপর হয়। অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ’৯৮-এর জুনে ৯৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে যমুনা নদীর উপরে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার পঞ্চম এবং বিশ্বের ৯২তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে ওঠায় সমগ্র দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর সুফল পরিলক্ষিত হয়।
২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই পর্বে জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। সামাজিক সূচকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সাথে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা এখন ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। এই একটি কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের সুনাম এখন অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে। মাত্র সাত বছরের মধ্যে এর বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসবে ও বাকি আট বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। এর আগে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। আর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মাসেতু ও পদ্মাসেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রোরেল, এলিভেটরি এক্সপ্রেসওয়ে, কর্নফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮.১২ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ২১০০ ডলারে উন্নীত করেছেন। সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি। ২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন না বাস্তব। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করব। এগুলো সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। শেখ হাসিনা যা বিশ্বাস করেন, জাতির জনকের মতো তাই তিনি বলেন এবং বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান তারই অদম্য প্রমাণ। জাতির জনক দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নি। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। অতীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনসাধারণ নানামুখী দুর্যোগ-বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়ে তা সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করি, এবারের করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা দায়িত্বশীল আচরণ করব ও সফল হব। এবং সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সব ধরনের প্রতিকূলতা জয় করে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশীল ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
tofailahmed69@gmail.com

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য