
নূহ-উল-আলম লেনিন : ব্রিটিশ রাজের ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর দেশভাগ যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখনই নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিনকে দলের নেতা নির্বাচন করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের ‘প্রধানমন্ত্রী’ নিয়োজিত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম গ্রুপের হাতে। কিন্তু দেশভাগের পর মুসলিম লীগের ক্ষমতা চলে যায় খাজা নাজিমুদ্দিন ও মাওলানা আকরাম খাঁ গ্রুপের হাতে।
ঐতিহ্যগতভাবেই খাজা গ্রুপ ছিল বাঙালি মুসলমান অভিজাত শ্রেণি ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এই দলে ছিল মুসলমান জমিদার, জোতদার, নবাব, খান বাহাদুর, খান সাহেব ধনাঢ্য এলিট-শ্রেণি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি মুসলমানের ছিল ধর্মীয় ভাবাবেগ, স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনা, জমিদারি প্রথা ও শোষণ-বঞ্চনার অবসানের আকাক্সক্ষা এবং একটি সুখী সুন্দর গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার স্বপ্ন। মাত্র এক বছর আগে যে মুসলিম লীগ ছিল বাঙালি মুসলমানের প্রতিনিধি ও আশা-ভরসার স্থল, খাজা নাজিমুদ্দিন-মাওলানা আকরাম খাঁ’র নেতৃত্বে সেই মুসলিম লীগই এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। অচিরেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করে।
গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ভিন্নমত বা সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপ থাকার কারণে মুসলিম লীগের পরীক্ষিত কর্মীরাও দল করার অধিকার হারিয়ে ফেলে।
দেশভাগের পর থেকে তৎকালীন নিখিল সর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতৃত্ব খাজা নাজিমুদ্দিন ও মাওলানা আকরাম খাঁ-র দখলে চলে যায়। তারা সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম অনুসারীদের কোনোভাবেই দলীয় কর্মকা-ে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করে। এমন কী পুলিশি নির্যাতনেরও পথ গ্রহণ করে।
একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নাজিমুদ্দিন গ্রুপ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ এবং বাংলা ভাষার বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলিম লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। দেশে সৃষ্টি হয় এক বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতার। এই শূন্যতা পূরণের মতো কোনো কার্যকর রাজনৈতিক দল তখন বাংলাদেশে ছিল না। এই রাষ্ট্রভূমিতেই শেখ মুজিব, শামসুল হক এবং তাদের অনুসারী তরুণরা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করে।
বিশেষ করে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম অনুসারীরা ১৫০ মোগলটুলী অফিসকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে নতুন ছাত্র সংগঠন। এই ছাত্রলীগের প্রাণপুরুষ ছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক যুবলীগ বাম সংকীর্ণতার জন্য অকার্যকর হলেও, এই সংগঠনের সাথে যুক্ত তরুণরা ছাত্রলীগ গঠন এবং ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের (১৯৪৯) ফলাফল সর্বোপরি মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ কর্তৃক সোহরাওয়ার্দীপন্থিদের সদস্য রসিদ বই না দেওয়া প্রভৃতি ঘটনাবলি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম লীগের সকল সম্ভাবনাকে তিরোহিত করে। প্রগতিপন্থিরা তীব্রভাবে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্লাটফরম তথা রাজনৈতিক দল গড়ার তাগিদ অনুভব করে।
ইতোমধ্যে কামরুদ্দিন আহমেদ ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল করেন। কিন্তু সেটি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে।
দেশভাগ ও সিলেট গণভোটের পর আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য টাঙ্গাইলের অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ আইনসভা থেকে পদত্যাগ করলে আসনটি শূন্য ঘোষিত হয়। এই শূন্য আসনে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। কিন্তু “নির্বাচনী হিসাব দাখিল না করার অজুহাতে ভাসানীর নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করা হয়।” [শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১০১] পরবর্তীকালে ওই আসনটি শূন্য ঘোষিত হলে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল উপনির্বাচনে শামসুল হক নির্বাচিত হন।
আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ও সিলেট গণভোটের নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানি তখন পূর্ববঙ্গেও রাজনৈতিক মহলে পরিচিত নেতা। খাজা নাজিমুদ্দীন গ্রুপ মওলানা ভাসানীকে ১৯৪৮ সালের টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দিলেও, নির্বাচনের পর হিসাব জমা না দেওয়ার অজুহাতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সদস্যপদ বাতিল করে। বস্তুত মওলানা ভাসানীকেও তারা সহ্য করতে পারেনি।
মওলানা ভাসানী স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী অনুসারীদের সঙ্গে একাত্ম হন। প্রবীণ নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়। মওলানা ভাসানী নিজেও একটি স্বতন্ত্র দল করার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা ও পরিকল্পনা যে শেখ মুজিব ও শামসুল হক করেছিলেন প্রবন্ধের শুরুর উদ্ধৃতিতে তা উল্লেখ করেছি। তবে শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে।
“কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? আর একজন ঢাকার পুরানা লীগকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থবল ও জনবল দুই-ই ছিল। এডভোকেট আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান এবং আনোয়ারা খাতুন এমএলএ সহযোগিতা করছিলেন। আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।”
Ñ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২০
মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নিষেধাজ্ঞার জন্য সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো হল পাওয়া যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় কাজী হুমায়ুন রশিদ তার কে এম দাস লেন-এর বাসভবন, রোজ গার্ডেনে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন’ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়। গ্রেফতার এড়াতে মওলানা ভাসানী সম্মেলনের কয়েকদিন আগেই রোজ গার্ডেনে অবস্থান নেন।
২৩ জুন (১৯৪৯) বেলা ৩টায় রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে সম্মেলন শুরু হয়। যেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ কর্মী উপস্থিত হন। প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমেদ খান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, শওকত আলী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামসুদ্দিন আহমেদ (কুষ্টিয়া), আতাউর রহমান খান, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রমুখ।
এছাড়া মাওলানা মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মাওলানা শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা এয়াকুব শরীফ, ঢাকা প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরির মালিক মাওলানা আবদুর রশিদ এবং রেল শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন ও অন্য নানা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে যোগ দেন। ফজলুল হক শেরে বাংলা কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি একটা ভাষণও দেন।” Ñ বদরুদ্দিন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খ-) মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃ. ২৪৭-২৪৮
সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। সূচনা বক্তব্য দেন মওলানা ভাসানী। সম্মেলনে একটি নতুন জাতীয়ভিত্তিক দল গঠনের প্রশ্নে ঐকমত্য থাকলেও, নাম নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। অনেকেই দলের নামের সাথে সাম্প্রদায়িক বিশেষণ অর্থাৎ ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আর একটি মুসলিম লীগ গঠিত হচ্ছে জানতে পেরে কামরুদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ এবং তাজউদ্দীন আহমদ সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। প্রথম অধিবেশনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা শেষে দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। খাজা নাজিমুদ্দীন, মাওলানা আকরাম খাঁ, চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রমুখদের দল হলো সরকারি মুসলিম লীগ এবং ২৩ জুন গঠিত দলটি হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ (আওয়াম অর্থ জনগণ)। আওয়ামী লীগ শব্দটি ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে মানকি শরীফের পীর সাহেব ব্যবহার করেছেন।
কর্মী সম্মেলনে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের মেনিফেস্টোর একটি খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হয় শামসুল হকের ওপর। সম্মেলনের পর ঐ খসড়া মেনিফেস্টো প্রকাশিত হয়। তবে সম্মেলনে শামসুল হক প্রণীত ‘মূল দাবি’ শিরোনামে একটি ১২-দফা দাবিনামা গ্রহণ করা হয়। দাবিনামায় বলা হয়Ñ
১. পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবে জনসাধারণ।
২. রাষ্ট্রে দুটি আঞ্চলিক ইউনিট থাকবেÑ পূর্ব ও পশ্চিম।
৩. অঞ্চলগুলো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। প্রতিরক্ষা-বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রা ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে থাকবে এবং অন্য সকল বিষয় ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৪. সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তিরা কোন বিশেষ সুবিধা বা অধিকারভোগী হবেন না কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত বেতন বা ভাতার অধিকারী হবেন না।
৫. সরকারি কর্মচারীরা সমালোচনার অধীন হবেন, কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থতার জন্য তাদের পদচ্যুত করা যাবে এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাদের ছোটখাটো বা বড় রকমের সাজা দেয়া যাবে। আদালতে তারা কোনো বিশেষ সুবিধার অধিকারী হবেন না। কিংবা আইনের চোখে তাদের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাত প্রদর্শন করা হবে না।
৬. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেনÑ যথা বাকস্বাধীনতা, দল গঠনের স্বাধীনতা, অবাধ গতিবিধি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার।
৭. সকল নাগরিকের যোগ্যতানুসারে বৃত্তি অবলম্বনের অধিকার থাকবে এবং তাদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হবে।
৮. সকল পুরুষ ও নারীর জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
৯. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে সকল নাগরিকের যোগদানের অধিকার থাকবে। একটি বিশেষ বয়সসীমা পর্যন্ত সকলের জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর ইউনিট গঠন করা হবে।
১০. মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ দেয়া হবে এবং কোনো অবস্থাতেই কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা হবে না। বিনা বিচারে কাউকে দ-দান বা নিধন করা হবে না।
১১. বিনা খেসারতে জমিদারি ও অন্য সকল মধ্যস্বত্ব বিলোপ করা হবে। সকল আবাদযোগ্য জমি পুনর্বণ্টন করা হবে।
১২. সকল জমি জাতীয়করণ করা হবে।
সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, সহ-সভাপতি : আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ খান এমএলএ, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান ও অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, জেলে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্য দুজন সহ-সম্পাদক ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও একেএম রফিকুল ইসলাম। কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। গঠিত হয় ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি। অচিরেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সুসংগঠিত প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন, ২৪ জুন আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দুদিন পর, ২৬ জুন কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও বাহাউদ্দিন জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘ইত্তেফাক’ প্রকাশিত হয়। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন মওলানা ভাসানী। পরে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলায় খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। দেশে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়। সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ সংকট সমাধানের দাবিতে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে ২০ অক্টোবর একটি বড় জনসভার আয়োজন করে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই জনসভা শেষে পুলিশ অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে। ২০ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি ঢাকায় আসছেন জেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ এবং একটি স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য সরকারের অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তা সত্ত্বেও খাদ্যের দাবিতে ২০ অক্টোবর সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী আগেই শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলেন ঐ দিন তিনি যেন গ্রেফতার না হন। ফলে শেখ মুজিব গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। মওলানা ভাসানী জনসভা থেকে কারকুন গাড়ি লেন-এ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে চলে যান। পরের দিন পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করেন। ভাসানী তাকে অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উদ্দেশ্য ছিল সোহরাওয়ার্দী, মানকি শরীফের পীর ও মিয়া ইফতেখার উদ্দিন প্রমুখ নেতাদের সাথে দেখা করা এবং পাকিস্তানভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে মতবিনিময় করা। অবিলম্বে যাতে সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানভিত্তিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন, সেটিও ছিল মওলানা ভাসানীর বার্তা। মওলানার নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে পলাতক অবস্থায় পাকিস্তান গমন করেন। কীভাবে তিনি পাকিস্তানে গিয়েছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ না করলেও পূর্ববঙ্গে ফিরে আসার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। করাচি থেকে প্লেনে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা-বেনাপোল-খুলনা হয়ে তিনি টুঙ্গিপাড়া আসেন। টুঙ্গিপাড়ায় কয়েকদিন থেকে ঢাকায় আসেন এবং যথারীতি গ্রেফতারবরণ করেন ১ জানুয়ারি ১৯৫০।
সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। এমন কী দীর্ঘদিন তার পূর্ব বাংলায় প্রবেশাধিকারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখে। সোহরাওয়ার্দী প্রথমে কলকাতা ত্যাগে ইচ্ছুক ছিলেন না। পরে তিনি স্থায়ীভাবে করাচিতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগকে নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত এক কর্মী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সোহরাওয়ার্দী এই উভয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকলেও, তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এই দু-দলের কোনোটির সঙ্গেই যুক্ত হয়নি। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে শর্তসাপেক্ষে দুই দল একীভূত হয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের শর্ত ছিলÑ এর নামকরণ, মেনিফেস্টো ও কর্মসূচির স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণœ থাকবে; কেন্দ্রীয় আওয়ামী মুসলিম লীগ এতে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সাংগঠনিক কমিটির ১৯৫৩ সালের ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগে অধিভুক্ত বা একীকরণের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল একটি শিথিল ধরনের কনফেডারেশনের মতো। জন্মলগ্ন থেকে শেষাবধি ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ তার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে।
জন্মলগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগও আদর্শগতভাবে শিলীভূত দল ছিল না। এটিও ছিল সেকুলার জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী, ডানপন্থি, মধ্যপন্থি এবং বামপন্থিদের একটি অভিন্ন প্লাটফরম। এই ভাবাদর্শগত ও রাজনৈতিক বৈপরীত্যের কারণে আওয়ামী লীগ ১৯৫৭, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭২, ১৯৭৮, ১৯৮৩ ও ১৯৯১ সালে বিভক্ত হয়। তবে বারবার বিভক্তির চেষ্টা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মূলধারা অক্ষুণœ ও ঐক্যবদ্ধ ছিল। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব খন্দকার মোশতাকসহ ৫৫ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জনের বিরোধিতার কারণে পাস হতে পারেনি। জনমত যাচাইয়ের নামে এই প্রস্তাব দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
লেখক : সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ