Sunday, September 24, 2023
বাড়িউত্তরণ-২০২২দ্বাদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা , জুন-২০২২আওয়ামী লীগের জন্মদিনে : ইতিহাসের আলোকে বাম-কমিউনিস্টদের ঐক্য-বিরোধের হালখাতা

আওয়ামী লীগের জন্মদিনে : ইতিহাসের আলোকে বাম-কমিউনিস্টদের ঐক্য-বিরোধের হালখাতা

  • শেখর দত্ত

ভূমিকা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৪তম জন্মদিন সমাগত। পাকিস্তানি আমলের প্রথম দিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী মনোভাব ও পূর্ব বাংলার প্রতি অবহেলার কারণে বিরোধী দল হিসেবে জন্ম নেয় এ-দলটি। ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতের ধারাবাহিকতায় বাঙালির অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে বর্তমান থেকে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব প্রদান দলটির শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার রূপকার ও অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম এ-দলটির ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। দলটির জন্ম ও বিকাশের সাথে জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানকারী শহিদ জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অসংখ্য নেতা ও কর্মীর রক্ত, ত্যাগ, মেধা ও শ্রম জড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জন্মলগ্ন থেকেই জাতীয় মূলধারা আন্দোলনের ভিত্তি ও পথরেখা রচনা করে চলেছে দেশের প্রধানতম আস্থাভাজন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে বাঙালি জাতির যা কিছু অর্জন, তার মূলে রয়েছে এই দল। নদী যেমন এক সরল রেখায় অগ্রসর হয় না, তেমনি আওয়ামী লীগের চলার পথও একরৈখিক নয়। বাঙালির সব সাফল্য-অর্জন-সুকৃতি নিয়ে নানা বাধা-বিঘœ, চড়াই-উতরাই, সবলতা-দুর্বলতা, আশা-নিরাশার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশ-জাতির স্বার্থে সুদীর্ঘ সাত দশক ধরে জনগণের সেবা করে যাচ্ছে। সুদীর্ঘ এই চলার পথে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐতিহ্যবাহী এই দলকে কখনও একা আবার কখনও বাম-ডান অন্যান্য দলের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে হয়েছে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ডানের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে ঐক্য করতে হয়েছে কম। আর ঐক্য হলেও তা স্বল্প সময়ের জন্য।
কিন্তু সরকারবিরোধী সংগ্রামের সময় তো বটেই, এমন কী সরকারে থাকলেও বাম-কমিউনিস্টদের কোনো না কোনো অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেছে। কোনো কোনো অংশ বিরোধিতাও করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের ঐক্যের দিকটি বিবেচনায় নিতে হলে প্রথমেই কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত; বাম ও কমিউনিস্টরা কখনও গণভিত্তিসম্পন্ন বড় দল ছিল না। তবে নিবেদিত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা-কর্মী দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও তেভাগা-টংক-নানকার কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের ত্যাগী ও অভিজ্ঞ প্রবীণ নেতাদের সক্রিয় অবস্থান আন্দোলন-সংগঠনের থাকায় রাজনীতিতে বাম-কমিউনিস্টদের একটা বিশেষ অবস্থান ছিল। দ্বিতীয়ত; জাতীয় রাজনীতির মূলধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং ঐক্যকে রক্ষা করার জন্য বাম-কমিউনিস্ট একাংশের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ঐক্যের শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ মূল্যায়নের দাবি রাখে, তৃতীয়ত; বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলন-সংগঠনের অংশ। ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাসীন পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ওই পার্টির ভ্রাতৃপ্রতিম দল। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দলের বিশেষ একটা অবস্থান ছিল। চতুর্থত; বাম-কমিউনিস্টদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য একই ধারায় একই রূপে অগ্রসর হয়নি। সম্পর্কে ঐক্য যেমন তেমনি সম্পর্কে ছেদ বা বিরতিও রয়েছে। কখনও সম্পর্কে তিক্ততাও সৃষ্টি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পার্টি ছিল বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অংশ। এই দিক বিবেচনায় বাংলাদেশে এখন যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার মধ্যে এই দুই দল সবচেয়ে পুরনো। ওই সময়ের অন্যান্য সব দল মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, তফসিল ফেডারেশন প্রভৃতি সব দলের বিলুপ্তি ঘটেছে। এটা সকলেরই জানা যে, রাজনীতি সব সময়েই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়। এই দিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই দুই দলের মধ্যে ঐক্য ও সংগ্রামের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তাই এই দুই দলে সম্পর্কের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ইতিহাসকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়।
এক. আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৬৫ সাল অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির রুশ-চীন দুই অংশে বিভক্তির পর্যন্ত; দুই. কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তির পর থেকে ১৯৯৩ সাল অর্থাৎ রুশ-চীন ভাঙনের পর থেকে ‘সংস্কারপন্থি-কট্টরপন্থি’ দুই অংশে বিভক্তি পর্যন্ত; তিন. ওই বিভক্তির পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত।

প্রথম পর্যায় : ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৫
পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের স্বৈরশাসন শুরু হয়। এর প্রথম প্রতিবাদ হচ্ছে মুসলিম লীগের মধ্য থেকেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার এক মাস দুই দিন পর কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা পায় এবং দলটি বি টি রণদীভ উত্থাপিত ‘হয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ রাজনৈতিক স্লোগান সংবলিত ‘রাজনৈতিক থিসিস’ গ্রহণ করে। সশস্ত্র বিপ্লব করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষে গৃহীত এই থিসিস ছিল অবাস্তব, উগ্র-হঠকারী ও ‘বামপন্থার শিশুরোগ’ বিশেষ। প্রসঙ্গত, কমিউনিস্ট পার্টি ভারত-বাংলা ভাগ তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সমর্থন করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণস্বার্থে কতক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ দাবি জনসভা ও মিছিলের মাধ্যমে উত্থাপন করে। কিন্তু সাত মাস যেতে না যেতেই দলটি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। তাই আওয়ামী লীগ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সশস্ত্র বিপ্লবকে সফল করার সংগ্রামে নিয়োজিত। তাই আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের দিনগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্য সম্ভব ছিল না।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিকভাবে এই উগ্র হঠকারী লাইনের সমালোচনা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি ওই লাইন পরিত্যাগ করে। ইতোমধ্যে জনগণের চিন্তা-চেতনার বিপরীত গণবিচ্ছিন্ন ও অবাস্তব উগ্র লাইন গ্রহণ করার ফলে মুসলিম লীগ তীব্র দমন-পীড়নের সুযোগ পেয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে, নেতারাও ছিলেন ওই সম্প্রদায়ের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশেষত দমন-পীড়ন শুরু হলে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে থাকে। পূর্ব বাংলায় থেকে যাওয়া নেতাদের আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। প্রভাবিত বা বেস এলাকা বিনষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলার পার্টি প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রাদেশিক কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নবজাগ্রত বিরোধী শক্তি আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাধারণভাবে মনে করত, এই দলটি মুসলিম লীগের বি-টিম। তাই সিদ্ধান্ত হয় জেলার সদস্যদের সম্মতিক্রমে ঐক্যের এই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে হবে। ঢাকা জেলা কমিটিসহ অনেক জেলায় ঐক্যের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়।
সূচনালগ্নের সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, শুরুতে এই দুই দলের তেমনভাবে ঐক্য হওয়া সম্ভব ছিল না। তবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যে পশ্চিম পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক ছিল, তা সুস্পষ্ট। ক্যুয়ের দেশ পাকিস্তানে ১৯৫১ সালের প্রথম ক্যু করে কমিউনিস্টরা। এটাই ছিল একমাত্র ক্যু, যা বামপন্থি। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহিদ, জেনারেল আকবর হোসেন, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ প্রমুখদের পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। সোহরাওয়ার্দী তাদের পক্ষ হয়ে মামলা পরিচালনা করেন। পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর আইনি লড়াইয়ে জয়লাভ করে ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে তারা মুক্তি পান।
তবে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আন্দোলনগত প্রশ্নে সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। কেননা রাজনীতিতে বাস্তবতা এবং তা থেকে সৃষ্ট গণমনস্তত্বের চাপ দল ও দলীয় কর্মীদের চিন্তা ও কর্মকে পরিচালিত করে। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের বি-টিম কথাটা তৃণমূলের কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের কাছে দ্রুতই ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৪৯ সালের খাদ্যাভাব, পঞ্চাশের দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রভাষা, সংবিধানের মূলনীতি, প্রাদেশিক নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলে দুই দল কাছাকাছি চলে আসে। মুসলিম ছাত্রলীগে দুই দলের সদস্য-সমর্থক নেতা-কর্মীরাই কাজ করতে থাকেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি কমিটিতে কমিউনিস্ট ছাত্র ও যুবনেতারা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে দুই দলের ছাত্রনেতারা ছিলেন এবং এই কমিটির বৈঠকেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার ভ্রুণ সৃষ্টি হয়, তাতে দুই দলের অবদান ছিল।
ভাষা আন্দোলনের সময় ফরিদপুর জেলে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ অনশন শুরু করেন। তাদের মরণাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন ওই জেলে কমিউনিস্ট নেতারা তাদের মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের পর শান্তি সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত সমাজতান্ত্রিক চীনে যান। শান্তি আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ ও চীন সফরের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনেকটাই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এদিকে দমন-পীড়নের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন বিলুপ্তির পথে গেলে ভাষা আন্দোলনের পর অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগও নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রূপ গ্রহণ করে। রাজনৈতিক ও আন্দোলনগত বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও এই দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঐক্যই মুক্তিযুদ্ধ অভিমুখী গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।
ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে মুসলিম লীগকে পরাজিত করতে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। কিন্তু সদ্য সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করাসহ বিভিন্নমুখী অপপ্রচার থাকায় এবং নেজামে ইসলামের আপত্তি থাকায় ওই ফ্রন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকে নেওয়া হয় না। আওয়ামী মুসলিম লীগে থাকা কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পান। প্রসঙ্গত, পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর শাসক-শোষকগোষ্ঠী আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠী গণতন্ত্র ও বাঙালির জাতীয় স্বাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পূর্ব বাংলার মূলধারার আন্দোলন বামমুখী হয়ে ওঠে। এটা বুঝা যাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রণীত ও যুক্তফ্রন্ট গৃহীত ২১-দফা বিবেচনায় নিলে। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতির জাতীয় মূলধারার আন্দোলন আরও বামমুখী হয়ে পড়ে।
মুসলিম লীগকে কবর দিয়ে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর টনক নড়ে। প্রথমে ৯২(ক) ধারা প্রয়োগ করে জরুরি আইন জারি ও গভর্নর শাসন প্রবর্তন করে এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে নেতাদের জেলে নেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের খেলা। যুক্তফ্রন্টের তিন নেতা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টি করা হয় পাঞ্জাবকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শাসক-শোষকগোষ্ঠীর টার্গেট। প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি তথা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী বিরোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। ফলে পূর্ব বাংলা প্রদেশে ও কেন্দ্রে চলতে থাকে দল ভাঙাভাঙি ও ঘনঘন সরকার পরিবর্তন। এরই ঘাত-প্রতিঘাতে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব-বিরোধ শুরু হয়। বামপন্থিরা সভাপতি মওলানা ভাসানীকে ঘিরে সংঘবদ্ধ হয়। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ সমর্থন না করলেও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান থাকেন নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। এরই জের ধরে আওয়ামী লীগে কর্মরত বাম-কমিউনিস্টদের তৎপরতায় আওয়ামী লীগ ভেঙে যায় এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ প্রতিষ্ঠা পায়। প্রসঙ্গত, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায়-সহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তখন এই ভাঙনের পক্ষে ছিলেন না।
পূর্ব বাংলার তিন নেতার মধ্যে বিরোধ ও দূরত্ব সৃষ্টির পরিণামে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে আসে আইয়ুবের সামরিক শাসন। সামরিক আইনের মধ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা ও তীব্র দমন-পীড়নের মধ্যে গোপনে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের ৩/৪টি বৈঠক হয়। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো রাজনৈতিক বাস্তবতা তখন ছিল না। ওই বৈঠকগুলোতে ঠিক হয় যে, ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করবে। এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্ত সৃষ্টিকারী। এরপর গোপনে থাকা কমিউনিস্ট ছাত্রনেতা মোহাম্মদ ফরহাদ ও ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গোপন বৈঠকে একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দুই দল ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্র আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তবে করাচিতে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে যায় সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও এই ঐক্যই হয়ে ওঠে ক্রমে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান চালিকাশক্তি। আন্দোলনের উত্থানের মধ্যেই বাম-কমিউনিস্টরা রুশ-চীন ভাঙনে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়। পরে গোপন কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙে যায়। ন্যাপ তখনও ভাঙে না। প্রথম থেকেই চীনপন্থিরা একদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ কৌশল গ্রহণ করে, অন্যদিকে বিপ্লবের সেøাগান সামনে আনে। রুশপন্থিরা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যের সেøাগান সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের নীতি গ্রহণ করে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের সম্পর্কের প্রথম পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত
প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়কাল সুদীর্ঘ। এই সময়কালের শুরু হয় বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাস দিয়ে আর শেষ হয় কলঙ্কের কালিমাকে কপালে ধারণ করে। দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর পর প্রথমেই জাতির সামনে সমুপস্থিত হয় শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত এবং আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন। চীনপন্থি বাম-কমিউনিস্টরা ৬-দফার বিরোধিতা করে এবং রুশপন্থি কমিউনিস্টরা মুক্তিসনদ হিসেবে স্বীকার না করেও সমর্থন করে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পর ৭ জুনের হরতালে রাজনৈতিক দল হিসেবে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাপের একটি অংশ এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) সমর্থন করে। রুশপন্থি বাম-কমিউনিস্টরা ছাড়া ৬-দফার সমর্থক কোনো রাজনৈতিক দল তখন ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে ন্যাপ ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আগরতলা মামলা প্রদান এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও ন্যাপ (মো) এবং ছাত্র নেতাদের গ্রেফতার করা হতে থাকে। তখন রুশপন্থি বাম-কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৬৮ সালের ৭ জুন ন্যাপ (মো) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) দিবসটি পালন করে। এই কালো দিনগুলোতে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্য বজায় থাকে।
ইতোমধ্যে আইয়ুব সরকার এবং তার দলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। এটা ছিল পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠী এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। এরই জের ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়। এই সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ডাকসু, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১-দফা। এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ (মো) সুকৌশলে ডানপন্থি দলগুলোর সঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ ডাক-এর ঐক্যবদ্ধ হয়। ন্যাপ (ভাসানী) এই ঐক্যে যোগ দেয় না। আইয়ুব খানকে চাপে ফেলা বা উৎখাত করে আগরতলা মামলা বাতিল করে শেখ মুজিবকে বের করে আনা, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলন অগ্রসর করা এবং ১১-দফা আন্দোলনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে এই ঐক্য যথাসম্ভব ভূমিকা রাখে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা বাতিল করে এবং বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং এর আগে-পরে তাজউদ্দীন আহমদ, মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফফর আহমেদসহ নেতারা মুক্ত হয়ে আসেন।
মুক্ত হওয়ার পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সের গণসংবর্ধনা সমাবেশের সভাপতি, ডাকসুর সহ-সভাপতি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমেদ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। জনগণ এই উপাধি লুফে নেয়। তবে মাত্রার পার্থক্য সত্ত্বেও রুশ ও চীনপন্থিরা এই উপাধি মেনে নেয় না। তখন থেকে জনগণ বঙ্গবন্ধু নামেই নেতাকে সম্বোধন করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার কণ্ঠস্বর। ভাসানী বহুধা বিভক্ত হতে থাকা চীনপন্থি গ্রুপগুলোকে নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করেন। আইয়ুব আহূত গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মওলানা ভাসানীর সাম্প্রতিক কথাবার্তার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নাই। তাই তাঁর রাজনীতি ত্যাগ করা উচিত। এখন তাঁর বয়স ৮৬ হইয়াছে।’ অনিশ্চিত এক অবস্থা বিরাজ করতে থাকলে এক সময়ে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন এবং রক্তপাতহীন ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসেন।
এই সময়ে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মো) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। জনগণের রায় এককভাবে পক্ষে আসবে বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ইস্যুকে মুখ্য করে তোলে এবং নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করে। ন্যাপ (মো) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) আওয়ামী লীগের একলা চলার নীতির সমালোচনায় নামে এবং ৬-দফা ও ১১-দফার প্রশ্নে আপস করে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া সমঝোতা হচ্ছে বলে মনে করে। নির্বাচন বয়কট করে বিপ্লবের স্লোগান তোলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থি গ্রুপগুলো। তবে দমন-পীড়ন, নির্বাচন বানচাল করে সামরিক শাসন অব্যাহত রাখা কিংবা শাসক-শোষক-শ্রেণির পছন্দমতো সংবিধান রচনা করা, পূর্ব বাংলাকে ভেঙে উত্তরবঙ্গ প্রদেশ বা চার প্রদেশ করা, যুক্ত নির্বাচন প্রথা বাতিল করা, শিক্ষানীতি প্রভৃতি ইস্যুতে কখনোবা ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করে।
পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর প্রতিভূ ইয়াহিয়া নির্বাচন বানচালের নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত এক লোক এক ভোট নীতির ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। তবে ৬-দফা যাতে বাস্তবায়িত হতে না পারে, সে-জন্য ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ও আইনগত কাঠামো (লিগেল ফ্রেমওয়ার্ক-এলএফও) ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনকে ৬-দফার প্রশ্নে গণভোট হিসেবে সামনে আনেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সামনে রেখে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি অর্থাৎ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। ন্যাপ (মো) পূর্ব পাকিস্তানের কোনো আসনে বিজয়ী হতে পারে না। এ পর্যায়ে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বাম-কমিউনিস্টদের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে ৬-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার পথ উন্মুক্ত হয়। এতে পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠীর টনক নড়ে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায় বাতিলের হীন উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচাল করার ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলতে থাকে।
শুরু হয় স্বাধীনতার সেøাগান নিয়ে জনগণের মিছিল-মিটিং। ছাত্রলীগ ও তৃণমূলের আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) শহিদ মিনারের জনসভায় স্বাধীন বাংলার পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরে। এটাই ছিল রুশপন্থি বামদের প্রথম স্বাধীনতা শব্দের উচ্চারণ। ন্যাপ (মো) পাকিস্তানের প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকারের দাবি সামনে আনে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব বাংলার প্রশাসন চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। জমায়েতের ভেতর দিয়ে ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ঘোষণা দেন। এই সময়ে ছাত্রলীগ নামের সঙ্গে যুক্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি যোগ করে। মওলানা ভাসানী ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে’ বলে ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর আলোচনা ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা শুরু হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি গ্রেফতার হন এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।
শুরু হয় বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মো) সরকারকে সমর্থন করে এবং ঐক্যের দাবি সামনে রাখে। এই দু-দলের ছাত্র ও যুব নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বাংলাদেশের সরকারের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং নিজস্ব গেরিলা বাহিনীও গঠন করে। চীনপন্থি দল ও গ্রুপগুলোর একাংশ একত্রে আলাদা বাহিনী গঠন করে। অন্য একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ দুই কুকুরের লড়াই বলে আখ্যায়িত করে। অন্য একটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সমর্থন দেয়। হানাদারদের পক্ষ নেয় আমেরিকা-চীন। মওলানা ভাসানীও সরকারকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (ভা), ন্যাপ (মো) ও জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ। এই ঐক্য ছিল দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঐক্য, যা মুক্তিযুদ্ধকে নবপর্যায়ে উন্নীত করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিংবা নিজেদের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো) বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও প্রগতির শক্তিকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এভাবে বাম-কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুল-তাজউদ্দীন সরকারের ২৫ দিনের শাসনামলে ন্যাপ (মো) সর্বদলীয় সরকারের দাবি সামনে আনে। মোশতাকের সহযোগী আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক কে এম ওবায়েদুর রহমান এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘সাহায্যকারী পাঁচ-দলীয় পরামর্শদাতা কমিটি’ বহাল থাকবে। পাকিস্তান থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশ সমাজতান্ত্রিক ধারায় অগ্রসর হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো) এই লক্ষ্য ও কর্মসূচির পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। মওলানা ভাসানী, ন্যাপ (ভা) ও চীনপন্থি গ্রুপগুলো বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতায় নামে। গোপনে থাকা কোনো কোনো গ্রুপ ‘পাকিস্তান’ শব্দটি দলের নামের সঙ্গে রাখে এবং সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের কর্মসূচি সামনে রাখে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ন্যাপ (মো) ক্রমে সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে থাকে। ন্যাপ (মো) গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পুরো সংবিধান সম্পর্কেই দ্বিমত প্রকাশ করেন এবং সংবিধানে স্বাক্ষর করেন না। ইতোমধ্যে বামপন্থি কর্মসূচি ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান সামনে রেখে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ দলের জন্ম হয়।
এ অবস্থায় ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল থেকে সিপিবির ভাষায় ‘সামান্য কিছু ঘটনা ঘটলে’ পুলিশ গুলি করে এবং দুজন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নিহত হন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথম গুলিবর্ষণ। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ও বাম-কমিউনিস্টদের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে। পরে মণি সিংহ-মোহাম্মদ ফরহাদসহ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। নির্বাচনে ন্যাপ (মো) বিকল্প সরকারের আওয়াজ উত্থাপন করে। জাসদ ও ন্যাপ (ভা) সরকার উৎখাতের আওয়াজ সামনে রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কমিউনিস্ট পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে। নির্বাচনের পর গোপন চীনপন্থি গ্রুপগুলো থানা-ফাঁড়ি-বাজার-হাটে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু এদের ‘রাতের বাহিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ (মো)-এর অবস্থানকে হঠকারী বলে আখ্যায়িত করে। দলটি আবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের নীতি গ্রহণ করে। ন্যাপ (ভা), চীনপন্থি গোপন ও প্রকাশ্য দল এবং গ্রুপগুলো সিপিবি ও ন্যাপকে আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। একপর্যায়ে ত্রিদলীয় গণ ঐক্যজোট গঠিত হয়। কিন্তু সেই জোট সচল হয় না। জাসদ দলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও করে এবং সেখানে রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে।
সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে উগ্রবাম ‘রাতের বাহিনী’ এবং সরকার ও সরকারি দলের অভ্যন্তরে ‘চাটার দল’ দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার লক্ষ্য সামনে রেখে একদল বাকশাল গঠন করেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো) বাকশালে যোগ দেয়। মওলানা ভাসানী বাকশাল সমর্থন করেন। বামপন্থি নেতা হাজি দানেশের দল জাগমুই বাকশালে যোগ দেয়। বাকশাল দলটি কাজকর্ম শুরু করতে না করতেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিদ্রোহী মেজরদের নেতৃত্বে ক্যু সংঘটিত হয় এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এটা ছিল মানব ইতিহাসের এক জঘন্যতম ও নির্মম হত্যাকা-। স্বঘোষিত খুনি মেজরদের সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে পাকিস্তানি চেতনা রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চলে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল ও হত্যার ঘটনা পর্যালোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উগ্র বামরা আঘাত করে; কিন্তু ক্ষমতায় বসে ডান প্রতিক্রিয়াশীল, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা। তখন আরও আক্রমণাত্মকভাবে ক্ষমতাসীন মহল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো)-কে ‘রুশ-ভারতের দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চালায়।
রাষ্ট্রপতি হয়েই খুনি মোশতাক একদিকে জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের নবীন প্রজন্মের নেতাদের জেলে নেন এবং দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রীদের মন্ত্রিপদে নিয়োগ দেন। ফলে নেতৃত্ব শূন্যতার মধ্যে পড়ে আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়সারি ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুনি মোশতাকের শাসনকে মেনে নেয় না। এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ আন্দোলনে নামে। এরই মধ্যে ঘটে খালেদ মোশাররফের আধখেঁচড়া ও পরিকল্পনাহীন ক্যু। এরই মধ্যে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী ‘সিপাহী বিপ্লব’ শুরু করে। খালেদ মোশররফের ক্যু ব্যর্থ এবং খুনি মোশতাকের শাসনের অবসান হয়। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে চলে আসেন পদত্যাগী ও বন্দী সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। ক্যু-পাল্টা ক্যু ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক কর্তাদের শাসন ও দক্ষিণপন্থি অধোগতির কবলে পড়ে দেশ।
জাসদ ও গণবাহিনী ছিল জিয়ার মুক্তিদাতা। কিন্তু তারা জিয়া আমলের শুরুতেই দমন-পীড়নের মধ্যে পড়ে। হুকুমের বিচারে মুক্তিদাতা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সেনা শাসনামলের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো)-এর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কমিউনিস্ট পার্টি ‘জিয়া সীমাবদ্ধভাবে দেশপ্রেমিক’ আখ্যায়িত করে খালকাটা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে এবং জিয়ার পক্ষে হ্যাঁ-ভোট দেয়। এর জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে মূল্য দিতে হয়। জিয়া এক সময় পার্টিকে বে-আইনি করে। ন্যাপ (মো) প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯-দফার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিয়ার বিরুদ্ধে জেনারেল ওসমানীকে প্রার্থী করে এই দু-দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণঐক্যজোটে শামিল হয়। ন্যাপ (ভা) ও চীনপন্থি দল ও গ্রুপগুলোর বড় একাংশ প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সমর্থন করে। পরে কোনো কোনো অংশ সরকারি দল বিএনপিতে যোগ দেয়। বিএনপির নেতা-মন্ত্রীদের একটা বড় অংশ ছিল ন্যাপ (ভা) ও চীনপন্থি দল ও গ্রুপগুলোর।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলে সব রাজনৈতিক দল ভাঙনের কবলে পড়ে। ভাঙনের ভেতর দিয়ে রুশ-চীন বাম-কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলোর একাংশ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে এবং অপরাংশসমূহ ক্ষতির মুখে পড়ে। এদিক বিবেচনায় জিয়ার শাসনামল হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষত বাম-কমিউনিস্টদের জন্য সবচেয়ে কালো অধ্যায়। আওয়ামী লীগ ভাঙনের কবলের পড়ে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে জিয়া আমলের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হন এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে সাহস-দৃঢ়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাত্তারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মো) ও কমিউনিস্ট পার্টি এবং জাসদ আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করে। বিচারপতি সাত্তার বিজয়ী হন। তবে তার শাসনামল বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এই সময় থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আবারও উন্নতির লক্ষণ দেখা দিতে থাকে।
দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সফল ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হয় ১৫-দলীয় জোট। এই জোটে আওয়ামী লীগসহ বাম-কমিউনিস্ট দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়। রুশ-চীন বিভক্তির পর পাকিস্তানি আমলে, মুক্তিযুদ্ধে ও বঙ্গবন্ধুর আমলে যেসব দল ও গ্রুপগুলো আওয়ামী লীগবিরোধী চরম অবস্থান গ্রহণ করেছিল, সেসব দলও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই জোটে শামিল হয়। অন্যদিকে চীনপন্থি বাম-কমিউনিস্টদের কতক গ্রুপ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত-দলীয় জোটে যোগ দেয়। পাঁচ-দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ ৮টি দল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে ১৫-দলীয় জোট ভেঙে যায়। ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ দুই গ্রুপ, সাম্যবাদী দল ও শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল মিলে পাঁচ-দলীয় জোট গঠিত হয়। এই জোট নির্বাচন বর্জন করে। মিডিয়া ক্যুর ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা আট-দলের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আবারও আট-দল, সাত-দল ও পাঁচ-দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যুগপৎ আন্দোলনে শামিল হয়। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের দল জামাতও এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকে।
গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের পতন ঘটে এবং তিন জোটের সমঝোতার ভেতর দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় বসে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সূক্ষ কারচুপির ভেতর দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত-দলীয় জোট বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে আট-দলীয় জোট থেকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, বাকশাল ও গণতন্ত্রী পার্টি নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, এসব বাম দলগুলোর বেশ কতক প্রার্থী কয়েকটি মার্কা নিয়েও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে বিজয়ী হয়ে এসব দল আওয়ামী লীগের বাইরে এসে বিবৃতিতে ঘোষণা করে, বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজি হলে তারা বিএনপিকে সমর্থন দেবে। তবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সাত-দলীয় জোট যুদ্ধাপরাধী জামাতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। ইতোমধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বপ্নভঙ্গ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতন ঘটে। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে এবং এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিশ্ব বামমুখী থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং বিভিন্ন মার্কা নিয়ে নির্বাচনের ঘাত-প্রতিঘাতে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে কমিউনিস্ট পার্টি ‘সংস্কারপন্থি ও কট্টরপন্থি’Ñ এই দু-ভাগে বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাম-কমিউনিস্টদের সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তৃতীয় পর্যায় : ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু
আওয়ামী লীগ ও বাম-কমিউনিস্টদের সম্পর্কের তৃতীয় পর্যায় এখনও চলছে। এই পর্বের শুরুর দিকে সাবেক রুশপন্থি বাম-কমিউনিস্টদের বড় একটি অংশ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম দল গঠন করে। পরে বৃহত্তর অংশ আওয়ামী লীগে এবং অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ বিএনপিতে যোগ দেয়। এই পর্বে বাম-কমিউনিস্ট দলগুলোর ভূমিকা ওলটপালট হয়ে যায়। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি যেসব বাম-কমিউনিস্ট দল বঙ্গবন্ধু সরকারের চরম বিরোধিতা করে রাজনীতিতে ক্ষতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, সেসব দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪-দলীয় জোট গঠন করে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে এমপি-মন্ত্রী হন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের পক্ষের সবচেয়ে একনিষ্ঠ দল কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এ পর্যায় এখনও চলছে। তাই পর্যালোচনার সময় এখনও আসেনি। তবে বিশ্ব পরিস্থিতির ডানমুখী পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনীতিতে অতীতের তুলনায় বাম-কমিউনিস্টদের ভূমিকা যে সংকুচিত হয়েছে, প্রভাব যে কমেছে, তা সুস্পষ্ট।

উপসংহার
দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত আওয়ামী লীগ জন্মের ৭৩ বছরের পথপরিক্রমায় বাম-কমিউনিস্ট দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য ও সম্পর্ক পর্যালোচনায় এ-কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, সম্পর্কের উন্নয়ন ও ঐক্য যখনই হয়েছে তখনই জাতি নবনব সাফল্য অর্জন করেছে। বাম-কমিউনিস্ট দলগুলোর জাতীয় রাজনীতিতে যতটুকু অর্জন ও সাফল্য, তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য ও সমঝোতারই ফসল। সবশেষে একটা কথাই বলতে হয়, আমাদের জন্মলগ্নের মর্মবাণী হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সমৃদ্ধ জাতীয় চার মূলনীতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার জীবনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জনগণের চেতনাকে ধারণ করে আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে জাতীয় চার নীতিÑ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতির মর্মমূলে প্রোথিত করেছেন। জন্মলগ্নের চেতনায় সমৃদ্ধ চার নীতি থেকে জাতিকে আর সে-সঙ্গে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন করার শক্তি কারও নেই। কিন্তু রাজনীতিতে এটাই চির সত্য যে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ কখনও একই সমতলে সোজা-সরল হয় না। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চড়াই-উতরাই, আঁকাবাঁকা, আগু-পিছু পথ অতিক্রম করে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার মধ্যে রয়েছে দেশ। এর মধ্যে বাম-কমিউনিস্টরা কোন্ ধরনের ভূমিকা নেবে, কোন্ ধরনের ভূমিকা নিলে টিকে থাকতে পারবে, ইতিহাসে মর্যাদা পাবে, তা বহুধা বিভক্ত বাম-কমিউনিস্ট দলগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। জন্মদিনের শুভলগ্নে আওয়ামী লীগের এমনটাই শপথ হবে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সূত্রায়িত চার মূলনীতির ভিত্তিতে জাতীয় পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে দেশকে অগ্রসর করে নিতে হবে।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুন মাসের দিবস
পরবর্তী নিবন্ধকর্মীনির্ভর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য