Sunday, September 24, 2023
বাড়িSliderআঁকাজোঁকা মুখ

আঁকাজোঁকা মুখ

আনিস রহমান: ভাবিনি। হঠাৎ এতগুলো টাকা পেয়ে যাব। যেন পথ চলতেই একটা টসটসে পাকা আম কুড়িয়ে পেয়েছি। বাঁ-দিকের হিপ পকেটে রাখা আছে টাকাগুলো। লম্বা একটা কাগজের প্যাকেটে ভাঁজ করে রাখা। কড়কড়ে নোট সব। হাজার টাকার নতুন নোট।
নোটের কথা মনে হতেই মাঝে মাঝে চাপ দি-ই হিপ পকেটে। মড়মড়ে কাগজের প্যাকেট। কেমন শক্ত শক্ত ঠেকে! না-কি খসখসে! মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাই তখন। খসখসে না শক্ত ঠাওর করতেই ভুলোমন আরও বেভুলো হয়ে যায়। কিন্তু শক্ত আর খসখসেতে কী যায় আসে! কাগজে মোড়ানো টাকা আছে, সেটাই বড় কথা। ফের টাকার কথা মনে হতেই পলকে শরীর কেমন হালকা হয়ে যায়। ফুরফুরে বাতাস খেলা করে শরীরজুড়ে। দুষ্টু প্রজাপতির মতো। তখন দুচোখ কী এক আবেশে বুজে আসে। বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো স্থির হয়ে বসে। আঁকাবাঁকা সব পথ মুহূর্তে সোজা হয়ে অনেকদূর গিয়ে মেশে। সে-পথ ধরে দিগন্তে চোখ যায়। মন যায় আকাশের নীলিমায় হারিয়ে। কখনও মনে হয় দিগন্তে মিলে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে আকাশের নীল, মাঠের সবুজ। সে-সবুজের দোলা হৃদয়জুড়ে।
মাঝে মাঝে মনে হতো টাকার ভেতর শয়তান লুকিয়ে আছে। তা না হালে টাকা নিয়ে এত অশান্তি কেন হবে? মানুষে মানুষে দূরত্ব। অবিশ্বাস। মুহূর্তে তৈরি হয় টাকার জন্যে।
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ভুল। টাকার ভেতরই শান্তি। টাকা শান্তির দূত!
রাজন অনেকদিন থেকেই ফোন করছিল।
– আমাদের নতুন অফিসে একবার ঘুরে যান। একবারও তো আসা হলো না। এবারের অফিস দেখতে কেমন তাও বুঝি জানতে ইচ্ছে হয় না! সময় করে একবার পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন, এই শেষ কথা!
– আমি বলি আসব?
– কবে কমল দা?
– একদিন দেখো ঠিকই চলে আসবো। সারপ্রাইজ দেবো।
– দেখা গেল সেদিন আমিই অফিসে নেই। সুতরাং সারপ্রাইজ দেবেন কী? আপনাকেই সারপ্রাইজ নিয়ে চলে যেতে হবে!
– মোবাইলের যুগ! হারাবে আর কোথায়? ঠিকই খুঁজে নেবো তোমাকে।
– কম্পিউটারের যুগ বলে আপনিও ই-মেইলে লেখা পাঠিয়ে খালাস। আগে হলে লেখাটা তৈরি করে ঠিকই সশরীরে আসতেন। তখন দেখা না করে কোথায় যেতেন? ডিজিটাল যুগের বিড়ম্বনা। শুধু অনুভব করতে পারি আপনি আছেন ঠিকই। দেখা হোক বা না হোক।
গেল দিন আবারও ফোন করেছিল রাজন।
– কমল দা আমাদের অফিসে আজ পিঠা উৎসব শুরু হয়েছে। দুদিন চলবে। বাহারে সব পিঠা। দারুণ টেস্ট। পেটচুক্তি। যত খেতে পারেনÑ খাওয়াবো।
– পিঠা উৎসব তোমার অফিসের। তখন তুমি পিঠা খাওয়াবে কেন?
– ঐ হলো আর কী! আপনি আসেন তো আগে!
ওর আবদার আর ফেলতে পারিনি। এমনিতে ছেলেটি দারুণ ভক্ত আমার। ভীষণ ভালোবাসে। সপ্তাহে দু-তিনবার অন্তত ফোন দেবে। খবর নেবে। সে তুলনায় আমি ওকে তিন মাসেও একবার ফোন করি কি না সন্দেহ। তাতে ওর অভিমান হয়। কিন্তু দূরে সরে যায়নি কখনও। তাই গতকাল আসতে পারিনি। নানা হ্যাপা সামলে শেষ অবধি আর আসা হয়নি। আজ সকাল থেকেই পণ করেছি, যে করেই হোক রাজনের অফিসটা একবার ঘুরে যাব।
বিকেল বিকেল যাতে পৌঁছতে পারি তাই দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়েই পথে নামলাম। প্রেসক্লাব থেকে তেজগাঁও আসতে তিন ঘণ্টা কাবাড়। তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। রাজনের সঙ্গে দেখা হতেই বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরিচয় করিয়ে দিল ওর সম্পাদকের সঙ্গে। আগত অনেক হোমরাচোমরা অতিথিদের সঙ্গেও। অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্যতা রক্ষার তাড়া। তার ওপর আবার নিউজরুমে যেতে হবে সে-তাড়া সব মিলিয়ে ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা ওর। তবু আমার প্রতি ওর পুরো দৃষ্টি। এ পিঠা-ও পিঠা, চোখে যেটা ভালো লাগছে তাই আমাকে খাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে রাজন। শেষে চা-সিগারেট পর্ব শেষ হতেই দেখি রাজন নেই। বেশ খানিক পরে সেলফোনে আমাকে বলল, যাবার আগে আমার অফিস হয়ে যাবেন। জরুরি আলাপ আছে।
অনুষ্ঠানের মাঠ থেকে বেশ খানিকটা দূরে অফিস বাড়িটি। বেশ সুন্দর। বাংলোমতো দেখতে। জোরালো আলো জ্বলছে প্রতিটি রুমে। আলোকময় বাড়িটি দেখতে বেশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল ও বাড়ির সবাই বেশ সুখী। বিশেষ করে দালান বাড়িটির চারদিকে অসংখ্য সবুজের ভিড়। আম-জাম-তালগাছ থেকে এমন কিছু নেই। রুম থেকে গলে গলে আলো এসে পড়ছে সবুজের ওপর। আলোয় ভিজা সবুজ বেশ লাগছিল। তার ওপর কুয়াশার চাদর। যেন ধোঁয়াশার চাদরে ঘেরা সে-সবুজ। অদ্ভুত রহস্যময় লাগছিল সবুজের সে ভিড় দেখতে। সেদিকে চোখ রেখেই একসময় দোতলায় গিয়ে উঠলাম। কাকে কী জিজ্ঞেস করবো, কে কী বলতে কী বোঝাবে। কে ধানাইপানাই জুড়ে দেবে। অত দিকদারি সইবে না! তারচে বরং রাজনকেই ফোন দি-ই। ফোন পেয়েই রাজন তড়িঘড়ি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাত একরকম টেনে নিয়ে গেল আরেক রুমে। হিসাব শাখা এটি। একজন লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে রাজন ফের ছুটলো নিউজ রুমের দিকে।
খানিকবাদে হ্যাংলাপনা গোছের ছেলেটি আমার হাতে হলুদ একটি খাম ধরিয়ে দিতেই আমি বেরিয়ে এলাম ওঘর থেকে। রাজনকেও আর বিরক্ত না করে নেমে এলাম নিচে। অবশ্যি খামটি হাতে নিয়ে আর খোলা হয়নি। খাম খুলে টাকা গুনে দেখা, ভাউচারের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া, এসব ঝকমারি আদৌ ভালোলাগে না আমার। নিজের কাছে ছোট মনে হয়। এবং সবাইকে চোর চোর ঠাওর করা হয়। আমি আবার তার চেয়ে এক কাঠি সরেস। ভাউচারে কেবল সাইন করেই ক্ষান্ত। কত টাকা লিখা আছে তাতে চোখ মেলে দেখিনি। তাই বাইরে এসেই প্রথমে খাম বের করলাম কোটের বুক পকেট থেকে। যত টাকা কামাই না কেন, লেখার সম্মানীর আনন্দই আলাদা। এর সুখ যেন কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা চলে না। বয়েস তখন সেই আঠারোর তরুণে গিয়ে ঠেকে। মনে রাজ্যির কৌতূহল।
এদিক-ওদিক তাকালাম। দেখি নিরাপত্তা প্রহরীরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্বস্তি। মূল ফটক পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম এবার। গেটের দু-পাশের দুটি ল্যাম্পপোস্ট। তার আলো খানিক ছড়িয়ে সামনে। এছাড়া পথের দুদিকে যদ্দূর চোখ যায় কেবল অন্ধকার। অথচ মনে কৌতূহল। কত টাকা খামে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ল্যামপোস্টের আলোয় খামটা মেলে ধরতেই বুকটা খ্যাচ করে উঠল। যা ভাবছি তাই, রিকশাঅলাগুলো হাভাতের মতো তাকিয়ে আছে আমার খামের দিক। খপ করে খামটা মুঠোয় পুরে একরকম দলা পাকিয়ে প্যান্টের সাইড পকেটে ঢোকালাম। তারপর আনমনে একবার এদিক একবার ওদিক তাকিয়ে ঝুপ করে একটা রিকশায় চেপে বসলাম। রিকশাঅলা দুহ্যান্ডেলে হাত রেখে শরীর বেঁকিয়ে রেখেছে আমার দিকে। চোখে প্রশ্ন। খানিক বিস্ময় খানিক বিরক্তি মিশে আছে। ওর চোখে চোখ পড়তেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলামÑ বাসস্ট্যান্ড যাও।
– বাসস্ট্যান্ড দুইডা, কোনডায় যায়াম?
– কাছে যেইডা।
লোকটা কী যেন ভাবলো। শেষে চাপা গলায় বলল, বিশ ট্যাহা লাগবো কিন্তু।
– তোমার কাছে ভাড়া জানতে চেয়েছি?
– গিয়া তো গড়বড় করবেন না, কি বিশ্বাস। আগে তিতা পরে মিডা ভালা।
– আমাকে দেখে কি মনে হয় তোমাকে ঠকাবো?
– মাইনষের শরীলে কি ভালা-মন্দ লেহা থাহে?
– তবু আমার কাপড়-চোপড় দেখে মনে হয় না…
– কাপড়… কাপড়ে যদি ভদ্দরনোক হয়, তয় কত হিরোইনচি আছে এই কলেজে। ভদ্দর লোকের লাহান দেখতে। কিন্তু হেরোইন না খাইলে চলে না। খাইব কোইত্তে? আমাগো মতো ফুটপাতের মাইনষের পকেট ধইরা টান দেয়। না দিয়া জানডা খোয়াইব কেডা?
ওর কথা শুনে কেমন যেন হোঁচট খাই। নিজের ভেতর ছোট হয়ে আসি। চোপসানো বেলুনের মতো। একসময় চৌরাস্তার মুখে এসে রিকশা থামায়। তাকায় আমার দিকে। আমার চোখে প্রশ্নÑ থামলে কেন?
– সোজাও যাওন যায়। বামেও রাস্তা আছে। কোন দিক দিয়া যামু?
– যেদিক দিয়া কাছে হয় যাও!
– কাছে অইলে তো অইবো না, হেরোইনচি আছে। পরে কইবেন আমিই ধরাইয়া দিছি।
– তুমি দেহি অনেক প্যাচাইলা মানুষ! আগে জানলে তোমার রিকশায় উঠতাম না।
– আমি যা কইছি মিছা কইলাম! ধরলে পরে আমারেই দোষ দিবেন। আমাগ জ্ঞান থেইক্কাই কইছি।
– কোন দিকে গেলে ধরবে না, সেদিকে যাও।
– বামে সম্ভাবনা কম বাঁচার আশা আছে। সোজা গেলে নির্ঘাত কাইত।
– তবে বামেই যাও। হেইডাও আবার আমারে কইতে অইবো?
– দিনে অইলে কথা ছিল না আমার ভাওমতো চলতাম। রাইতে পদে পদে বিপদ। তাই প্যাসেঞ্জারের বুঝমতো চলি। এত ঝুটঝামেলায় জড়ায় কেডা?
– এদিকের সব রিকশাঅলাই তোমার মতো বুঝঅলা?
– মানে?
– মানে প্যাচাইলা? তোমার মতো প্যাচাইলা কি না জানতে চাচ্ছি।
– পরের কথা ক্যামনে কমু। নিজের জ্ঞান থেইক্কা বুঝ থেইক্কা যা বুঝি তাই কইলাম! বুঝলেন কাহা? দুনিয়ায় অহন ভালো মানুষের যেমন ভাত নাই, ভালো কথারও তেমন জাত নাই! কে মূল্য দেয় ভালো কথারে? যেমন আপনি আমারে প্যাচাইলা কইলেন!
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হলো। ওদিকে সামনেই একটি বাস। মতিঝিল যাবে। সুতরাং আর কথা না বাড়িয়ে ৩০ টাকা ওর হাতে দিয়ে দৌড় দিলাম। অমনি সবুজবাতি। গাড়ি সাঁই করে টান দিল। আমি পথেই। পেছনে তাকিয়ে দেখি রিকশাঅলা আরেক প্যাসেঞ্জার নিয়ে কেবল রিকশায় টান দিয়েছে ডান হাত সিটের তলায় রেখে। তখুনি ফোন রাজনের। ও আমাকে অ্যাকাউন্টস সেকশনে বসিয়ে দিয়ে রুমে ফিরে গেছে। পিক আওয়ার। অনেকগুলো নিউজ জমে আছে। তখুনি ছাড়তে হবে। সম্পাদক তাড়া দিচ্ছেন বারবার। তাই ফেরার সময় আর কথা হয়নি! এবার ওর ফোনÑ
– স্যরি কমল দা। কথা বলতে পারলাম না। সাত হাজার বুঝে পেয়েছেন তো?
– একটু যেন ধাক্কা খেলাম। কীসের টাকা?
– রেজা কি বিল দেয়নি আপনাকে?
– ও দিয়েছে… স্যরি… ভীষণ শব্দ। ঠিক শুনতে পাচ্ছি না।
– সাত হাজার টাকা বুঝে পেয়েছেন তো! চারটে লেখার বিল।
– তা গুনে দেখিনি। অসুবিধে নেই। কম দেবে আর কে? বাড়ি পৌঁছে তোমাকে ফোন দেব।
লাইন কেটে গেল। ছ-সাতটা বাসের পেছনে ফের মতিঝিলের একটা বাস। চোখে পড়তেই ঠেলেঠুলে গিয়ে উঠলাম। মাঝখানে একটা সিটও পেয়ে গেলাম।
কিছুদিন হলো নতুন এ কাগজটায় যোগ দিয়েছে রাজন। কিন্তু এত হাইরেটে ওরা লেখক সম্মানি দেয়, জানা ছিল না। চারটে লেখার জন্যে নগদ-নগদ সাত হাজার টাকা দিয়ে দিল। এ তো দেখছি আলাউদ্দিনের চেরাগ পাওয়ার মতো ঘটনা। আরও বেশি বেশি কেন লেখা দেইনি এবার আফসোস হচ্ছিল। এমনিতেই আমি কম লিখি। তার ওপর নতুন কাগজ। সার্কুলেশন এখনও তেমন জমে ওঠেনি। লেখক সম্মানি দেবে কি দেবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব ভেবে নিয়মিত লেখা দিতে গা করিনি। যদ্দূর দিয়েছি, রাজনের চাপে পড়ে। এখন মনে হচ্ছে লেখকদের দিন ফিরছে। পত্রিকার সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে। এমন চললে ন’টা-পাঁচটা আর চাকরি করে কে! লিখেই মাইনের ডাবল কামানো যাবে। এমনি ভাবনায় ডুবে ছিলাম। তার ওপর ছুটোছুটিতে বুক উঠছিল-নামছিল হাঁপরের মতো। এবার হাঁপ ধরে আসতে এবং স্বস্তির হতেই তাকালাম পাশের লোকটির দিকে। আশ্চর্য! কনকনে এ শীতে গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। হাতাঅলা একটা গ্যাঞ্জি। বুকে পিঠে পেটে ছেঁড়া কয়েক জায়গায়। গামছা দিয়ে মাথা প্যাঁচানো। তার অর্ধেকটা গায়ে জড়ানো।
লোকটির চোখে-মুখে এক ধরনের নির্লিপ্ততা। বাতাস যে এত ঠা-া, কাঁপুনে হাওয়ায় সবকিছু জড়সড়, তা ওর ভাবগতিক দেখে মনেই হয় না। আচমকা সেলফোনের কথা মনে হতেই বুক পকেট সাইড পকেট হাতড়ে দেখি কোটের বাঁ পকেটে ফোন সেটটি জবুথবু হয় পড়ে আছে। পকেটের মুখ বিরাট হাঁ হয়ে আছে। তবু পকেটে হাত রেখে, চেপে ধরে তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।
কয়েক প্রস্ত গরম কাপড় তার ওপর কানটুপি চাপিয়েও যেখানে শীত মানছে না। দাঁতে দাঁত ঠেকছে সেখানে এক প্রস্থ গামছায় কী করে শীত ঠেকে! পাশাপাশি বসে। তবু এতক্ষণ লোকটিকে খেয়াল করিনি। এখন চোখে পড়তেই রাজ্যির অস্বস্তি আমাকে ছেঁকে ধরল। একটু নিজের মতো থাকব, এক মনে ভাবব তার আর জো নেই। বারবার চোখ যাচ্ছে লোকটির দিকে। শক্ত চোয়াল, গাল দেবে গেছে ভেতরে অনেকখানি। চোখ দুটো কোটরে লুকিয়ে আছে। রাতের পেঁচার মতো। থুতনিতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো নিষ্প্রভ। কোনো ভাষা নেই। যেন বধির। কোনো রংও নেই চোখে। নিষ্প্রাণ মরা মাছের মতো।
আমি খানিক পরপরই ফিরে ফিরে চোখ রাখি লোকটির মুখের ওপর। দেখি ওর চোখের পলক পড়ে কি না? কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল লোকটি স্বাভাবিক কেউ নয়। হয় লোকটি ধূর্ত শেয়াল, না হয় অসম্ভব নিষ্ঠুর। এবং মানুষ নিয়েই ওর কারবার। মানে লোকটি মানুষ মারার যন্ত্র। পয়সা পেলেই যে কারো কল্লা নামিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। ভাবতেই ফের হাত চলে যায় কোটের বাঁ পকেটে। শীতের কনকনে হাওয়ায় মোবাইল সেটটি ঘুমোচ্ছে আয়েশি ভঙ্গিতে। পকেট খানিক সময় চেপে ধরে ফের তাকাই লোকটির দিকে। দেখি মোবাইলের দিকে ওর চোখ পড়ছে কি না। ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওর অভিব্যক্তিহীন চোখ থেকে। তবু পকেট চেপে রেখে মোবাইলের অস্তিত্বের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখি খানিক সময়। একসময় হাত আলগা হয়ে যায় পকেট থেকে। পকেটখানি হাঁ হয়ে যায়। ভাঙা রাস্তায় গাড়ির বেজায় ঝাঁকুনি। তখন পকেটের মুখ আরও খানিকটা হেলে পড়ে কী এক অবসন্নতায়। ঝাঁকুনির তালে তালে মোবাইল সেটটিও মাঝে মাঝে উঠে আসে পকেটের মুখ অবধি। চমকে ফের পকেট চেপে ধরি। বোঝার চেষ্টা করি লোকটির মতিগতি। তখুনি বেশ কর্কশ স্বরে আশপাশে কার যেন সেলফোন বেজে ওঠে। দেখি লোকটি শরীর খানিক ওপর দিকে ঠেলে দিয়ে লুঙ্গির কোঁচড় থেকে মোবাইল বের করছে। আমার মাথায় বাজ পড়ল। এ লোকের হাতেও মোবাইল! কোনো সন্দেহ নেই। লোকটি নির্ঘাত ভালো মানুষের ভড়ং ধরে আছে! কেউ যাতে কোনোরকম সন্দেহ করতে না পারে তার সব রকম কায়দাকানুন ওর ভালোই জানা। কিন্তু মোবাইলে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না। গলা চেপে কথা বলেছে, ঠিক তাও নয়। লোকটির ভাষা দুর্বোধ্য ঠেকেছে। চাটগাঁ-সিলেটের ভাষাও তো কম-বেশি বুঝতে পারি, বলতে না পারলেও। সেখানে লোকটির একটি কথারও মানে বোঝা গেল না! তবে কী রোহিঙ্গা কিংবা আসাম-ত্রিপুরার কেউ হবে? না-কি আদিবাসী! এবার লোকটিকে আরও ভালো করে পরখ করি। চোখ-মুখ খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ করি। নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করি। না আদিবাসী বলে তো মনে হয় না। তবে কী লোকটি সংঘবদ্ধ কোনো দলের এজেন্ট। সাংকেতিক শব্দে কথা বলেছে হয়তো। নির্ঘাত আমাকে টার্গেট করে কোনো পরিকল্পনারও ছক এঁকেছে ওরা। হঠাৎ আমার নাকে ঝাঁঝালো গন্ধ আসে। বামের গন্ধ! তবে কী লোকটি মলম পার্টির সদস্য। আমার চোখে মলম দেয়ার পাঁয়তারা করছে? সব দেখে-শুনে এবং ভেবে কনকনে ঠা-ায়ও হাঁপ ধরে আসছে। হাঁসফাঁস লাগছে রীতিমতো। কোন বুদ্ধিতে লোকটির পাশে এসে বসেছিলাম। এখন কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। জুতমতো একটি সিটও ফাঁকা হয়নি এতক্ষণে। ফের লোকটিকে দেখি। অভিনয় জানে বটে। লোকটি নিশ্চিত অভিনয় করছে। মাত্রাতিরিক্ত অভিনয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। তারপর সটকে পড়বে মোবাইলটি নিয়ে। বড্ড শখের সেট এটি। দাম যাই হোক, দেখতে বেশ। আর দামও তো একেবারে আহামরি নয়। ভালো কিছু টাকা নেমেছে সেটটি কিনতে। উৎকণ্ঠায়-আশঙ্কায় আমার সারাশরীর নিশ্চল। তার ওপর চরম বিরক্তি। আমার গলার ঝাঁজ ফুটে ওঠে।
– আপনি কোথায় যাবেন?
লোকটি বিস্ময় নিয়ে বেশ খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অনাহূত এ প্রশ্ন ওর আত্মসম্মানে ঘা দিয়েছে বোধহয়।
– যাত্রাবাড়ি যামু।
– কোত্থেকে এলেন?
– গাজীপুর।
– কী করেন?
– বোজা বাই তারপর একটু থেমে, কাওরান বাজারে।
কেন যেন ওর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না!
– আর কিছু করা হয়!
– আর কিছু করার সময় থাহে!
ওর কণ্ঠে এবার ঝাঁজ। বোধহয় আর কথা বলতে চাচ্ছে না। বুকে দু-হাত আরও আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে জানলা গলে বাইরে তাকায়। ঝাপসা কাচে বাইরেটা খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কাচের কাছাকাছি মুখ নিয়ে কী যেন আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। এবার আমার সন্দেহ আরও বাড়ে। নির্ঘাত আমাকে এড়ানোর জন্যেই কথা বলতে চাচ্ছে না! কিংবা ওর দলের কেউ বাসে উঠবে, তাকে খুঁজছে। সুতরাং সাবধানের মার নেই। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটি মুঠোবন্দি করে রাখি। তাপে-উত্তাপে মুঠোর ভেতর বিন্দু বিন্দু ঘামতে জমতে থাকে টের পাই। কী এক অস্বস্তি! শেষে মোবাইলটি বের করে প্যান্টের পকেটে রাখতে যাবো, তখুনি চোখাচোখি হয় লোকটির সঙ্গে। আড়চোখে ঠিকই খেয়াল করছে মোবাইলটি কোথায় রাখি। আমার হাত সরে না। লোকটিকে অবিশ্বাস করেই যে মোবাইল সরিয়ে রাখতে চাচ্ছি, তা ঠিকই বুঝেছে ও। সংকোচ যেন আমার হাত চেপে ধরে। লোকটি কী ভাববে! কোটের ডান পকেটে রাখবো তাহলেই হয়েছে। বারো চোরে তখন পকেট ঘাঁটবে। বাসের দুপাশে সিট। মধ্যে করিডোরে। করিডোরে মেলা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমার শরীর ঘেঁষে দু-তিন জন রড ধরে আছে। সুতরাং কোটের পকেট যেমনি হা হয়ে থাকে, তখন মাত্তর দু-আঙ্গুলেই হাত সাফাই সম্ভব। এবং চোখের পলকেই। তাই সবকিছু ভেবে ডান পকেটের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফের বাঁ পকেটে সেটটি রেখে বসলাম। মনে হলো লোকটি খুশি হলো এবার। সেও একটু নড়েচড়ে বসলো। নতুনভাবে মাথা খেলাচ্ছে হয়তো।
এরই মধ্যে কন্ডাকটর ভাড়া নিতে এলো। আমাকে তাড়া দিল কিন্তু পাশের লোকটিকে কিছুই বলল না। হয়তো ভাড়া আগেই মিটিয়ে দিয়েছে ও। না হয় ওদের সঙ্গে লাইন-জাইন আছে। ভাগবাটোয়ারা করেই খায়। লোকটা অনেক সময় বুকের কাছে হাত ধরে রেখেছিল। হঠাৎ ডান হাতটা খসে পড়লোÑ ঝাঁকুনিতে কিংবা তন্দ্রায় হয়তো লোকটির চোখ বুজে এসেছিল। হাতটা পড়লো একেবারে পকেটের ওপর। আমি খপ করে কোটের পকেটে হাত রেখে লোকটির দিকে তাকালাম। আমার চোখে-মুখে রাজ্যির বিরক্তি। নির্ঘাত মোবাইলটি নিয়ে কেটে পড়বার তালে আছে। এবার আর লুকোছাপা নেই। বড় বড় চোখ করে তাকালাম লোকটির দিকে। কিন্তু মৃদু আলোয় বোঝা গেল না লোকটি ঘুমোচ্ছে, না জেগে আছে। তবে লোকটির ঘাড় একটু হেলে আছে পেছন দিকে।
অনেকক্ষণ ধরে জ্যামে বসে আছি। হঠাৎ লোকটির কণ্ঠÑ
– স্যার কয়ডা বাজে?
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। শেষে মোবাইলটা বের করে বললামÑ ৯টা বাজতে ১০ মিনিট এখনও বাকি!
সময় জানতে চাওয়া অজুহাত মাত্র। খুব বেশি সুবিধাজনক মনে হলো না। হাত সাফাইয়ের আগে শেষ ভণিতা। আমি মোবাইল চেপে ধরলাম আরও শক্ত করে।
এমনি করে আরও ঘণ্টাখানেক বাদে মতিঝিল এলো বাস। যাত্রাবাড়ির প্যাসেঞ্জররা রীতিমতো হামলে পড়েছে। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মোবাইলটি শক্ত হাতে চেপে ধরে একরকম ঠেলেঠুলে নেমে এলাম।
পাশের প্যাসেঞ্জার নেমে যেতেই লোকটির চোখ গেল ওর সিটের ওপর। ফিকে হলুদ রঙের একটা খাম। দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে খামটি তুলে নিয়ে আলোয় মেলে ধরলো। এক হাজার টাকার নোট। প্যাকেটটা ওপর-নিচ একবার ঝাঁকি দিল। বেশ ক’টি নোট। তবে নিশ্চিত হতে পারছে না নোট ক’টি। আর দেরি না করে মুহূর্তে জানালার কাচ সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। অগুনতি মানুষের ভিড়ে আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তবু যতটা সম্ভব আতিপাতি করে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ দেখে ভিড় ঠেলে লোকটি উত্তরে হাঁটা দিয়েছে। তেমনি আগের মতো কোটের বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে আছে। জানালা গলে মাথা বের করে লোকটি গলা ছেড়ে ডাকতে থাকেÑ
– ও স্যার ও স্যার।
– এই যে, কোটপরা স্যার।
এই যে স্যার! কোনোভাবেই ওর কানে যাচ্ছে না সে-ডাক। অগত্যা কাছেপিঠে এক লোককে ইঙ্গিত করলো আমাকে ডাকতে। লোকটি একরকম দৌড়ে আমার সামনে এসে বলল,
– আপনাকে ডাকছে?
– আমাকে?
আমি চমকে উঠি। আমি লোকটির দিকে তাকাই। চোয়াল শক্ত করে। ভ্রƒ কুঁচকানো। চোখ দুটো একরকম বুজে নিয়ে। – কে ডাকছে? মানসিকভাবে শক্তি অর্জনের চেষ্টা আমার মনে-প্রাণে।
লোকটি ইশারার পেছনে দেখালো। কিন্তু পরিচিত কাউকে দেখলাম না।
দীর্ঘসময় পর বাসের খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে দিগ-বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটছিলাম। এ শীতেও ঘামের ফুটকি কপালে। ঘাড়ে। তার ওপর যেমনি দলাই-মলাই খেলাম নামার সময়। তখন অচেনা পথিকের পথ আগলে দাঁড়ানো। দারুণ ঘাবড়ে গেলাম। পাশের লোকটির এজেন্ট ও। ওর পক্ষ হয়ে আমাকে এখনও ফলো করছে। এলাকা বদল হলে ওরা না-কি নিজের খদ্দের অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়। তবে কী… কপাল কুঁচকে লোকটির দিকে ফের তাকাতেই ও পেছনে আরও পেছনে দেখালো হাত তুলে। দেখি পাশের সেই লোকটি জানালা গলে মাথা বের করে আমাকে ডাকছে। একটি খাম হাতে ধরে আছে সে, খাম নেড়ে আমাকে ডাকছে। যতটা সম্ভব হাত উঁচু করে খামটি আমার দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করছে। ধাই করে আমার মনে হলো। রাজনের অফিস থেকে দিয়েছিল খামটি। ভেতরে না-কি সাত হাজার টাকা। মোবাইলের দিকে চোখ রাখতে গিয়ে প্যাকেটের কথা নির্ঘাত ভুলে বসেছিলাম। দৌড়ে গিয়ে অনেকগুলো মাথা ছাড়িয়ে হাতটি কোনোরকম জানালার কাছে নিলাম। লোকটি খাম হাতে তুলে দিয়েই তেমনি নির্লিপ্তভাবে জানালার কাচ বন্ধ করে দিল। আমি যে একটু ধন্যবাদ জানাবো কিংবা বখশিস! তার সুযোগও দিল না। তাই দরজার কাছে চলে গেলাম ঠেলেঠুলে। একটু ধন্যবাদই বা না দি-ই কেমন করে!। শুধু ধন্যবাদ! লোকটির কাছে অন্তত ক্ষমা চাইতে হবে। অনেক বড় পাপ হয়েছে। নিঃশর্ত ক্ষমা না পেলে এ পাপমোচন হবে না। কিন্তু বাসের রড ধরার আগেই ট্রাফিকের হুইসেল বেজে ওঠে ঘনঘন। ড্রাইভারও তড়িঘড়ি বাসটি নিয়ে টান দেয়। চোখের পলকে অনেক দূর চলে যায় বাসটি।
কী এক অপরাধে পুড়তে থাকি আমি। খামটি পড়ে থাকে হাতের মুঠোয়। খুলে দেখারও ইচ্ছে হয় না আর।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য