Wednesday, October 4, 2023
বাড়িSliderঅস্ট্রেলিয়াকে লজ্জায় রাঙিয়ে নতুন সম্ভাবনার ‘টিম বাংলাদেশ’

অস্ট্রেলিয়াকে লজ্জায় রাঙিয়ে নতুন সম্ভাবনার ‘টিম বাংলাদেশ’

আরিফ সোহেল: টি-টুয়েন্টি ভার্সনে শুরু থেকেই বাংলাদেশের অবস্থান নড়বড়ে। অথচ ২০০৬ সালে এই ভার্সনে দারুণ সূচনা ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। পরের ৪ ম্যাচের মধ্যে ৩টিতে জয়। ফলে বেজায় আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। এই ভার্সনে টেস্ট মর্যাদার সব দেশই রয়েছে বাংলাদেশের ওপরে। তবে জিম্বাবুয়েতে অল আউট জয়ের পর; দেশে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ানডের পর এই সংস্করণে এবার ‘টিম বাংলাদেশ’কে দেখছে অনেকেই। আর পরের সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একেকটি জয়ে স্পর্শ করবে নতুন মাইলফলক। এক জয়েই আফগানিস্তান, শ্রীলংকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ। আর সিরিজ জিতলে এগিয়ে যাবে আরও একধাপ।
ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ভার্সনে বাংলাদেশ হরহামেশাই নার্ভাস। অথচ দেখতে দেখতে ১০৭ ম্যাচের নামের পাশে সাকিব-মুশফিকরা। হারের সংখ্যায় ব্যাকুল বাংলাদেশ বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়াকে ধরায় নামিয়ে এনে নতুন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সংক্ষিপ্ত ভার্সনে জয়দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই ওয়ানডেতে নতুন বাংলাদেশকে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। তারপরও সমালোচনাকারীরা তাদের আলো-আঁধারীর ডেরা থেকে বের হতে পারেনি। বারবার নানা প্রশ্নে জর্জরিত করার চেষ্টা করেছে। ফোঁড়ন কেটেছে। পারফরমেন্স নিয়ে যখনই কথা উঠেছে তখনই পরাশক্তির দলগুলোকে হারিয়ে মোক্ষম জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডেতে হারাচ্ছে নিয়মিতই।
এতদিন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে হতাশা যেন অমাবস্যার মায়াবী চাঁদেই ঢাকা ছিল। বাংলাদেশের ছন্দে ফিরতে একটু বেশি সময়ই লেগে গেছে। জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয় থাকলেও টি-টুয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বেশ নাজুক সময় পার করেছে। এই ভার্সনে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮টি ম্যাচ জিতেছে। হেরেছে ৭৬টিতে। আর ম্যাচ প- হয়েছে দুটি। বাংলাদেশ দল এখন পর্যন্ত ৩৪টি টি-টুয়েন্টি সিরিজ খেলেছে। যেখানে সিরিজ জয়ের দেখা পেয়েছে মাত্র ৮টিতে। এর মধ্যে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত ১৬টি সিরিজে বাংলাদেশের জয় ৫টিতে। সেখানে দুটিতে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। আর বাকি দুটি পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তাই এবার শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় ছিল বাংলাদেশের জন্য অনন্য এক প্রাপ্তি। তবে টি-টুয়েন্টি ইতিহাসটা দুঃখের ভেলায় সাজানো এখনও।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। ১৫ বছরের মাথায় অস্ট্রেলিয়া খেলছে বাংলাদেশের বিপক্ষে। বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ৪-১ কে উড়িয়ে দিয়েছে এক ফুৎকারে। এই সিরিজ শুরু আগে সবকটি ম্যাচে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ব্যবধান ছিল ৪-০। সেখান থেকেই বাংলাদেশ এখন ৪-৫।
টি-টুয়েন্টিতে সবচেয়ে চোখ জুড়ানো পরিসংখ্যান জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে; ১১ জয়ের সঙ্গে ৩টি সিরিজ জয়ের গল্প। হার মাত্র ৫ ম্যাচে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও বাংলাদেশের টি-টুয়েন্টির জয়ের হিসাবটা মন্দ নয়। ৬ ম্যাচ হারলেও এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ৫ জয়ের সঙ্গে সিরিজ জয়ও রয়েছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬ ম্যাচের সবগুলোই হেরেছে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ১০ হারের বিপক্ষে জয় মাত্র একটি। পাকিস্তানের বিপক্ষেও ২ জয়ের বিপক্ষে হার ১০টি। শ্রীলংকার বিপক্ষে ৪ জয়ের পাশে ৭ হারের চিহ্নটীকা। আফগানিস্তানে হার মেনেছে বাংলাদেশ। ৪ হারের বিপরীতে জয় মাত্র দুটিতে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এর আগে ১০ ম্যাচে সবকটিতে হেরেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের গল্পটাই আলাদা। বাংলাদেশে আসার আগে নানা শর্তে জর্জরিত করে রেখেছিল। হোটেল থেকে মাঠের গ্যালারিও তাদের শর্তের বৃত্তে নিয়ন্ত্রিত ছিল। শর্তের বেড়াজালে পরিবেশ-পরিস্থিতির শতভাগ পক্ষে নিলেও মাঠে দাম্ভিক অস্ট্রেলিয়ার আসহায়ত্ত ফুটে ওঠে ২২ গজের চৌহদ্দিতে। প্রথমটিতে ২৩ রানে হারার পর, দ্বিতীয়টিতে হেরেছিল ৭ উইকেটে। ৩, ৪, ৬, ৭ ও ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত সিরিজে বাংলাদেশ ২ ম্যাচ হাতে রেখেই আসর নিজেদের করে নিয়ে বিষম লজ্জায় বিমর্ষ করেছে অস্ট্রেলিয়াকে। প্রথম ম্যাচে বাংলাশের ১৩১ রানের জবাবে সফরকারীদের সংগ্রহ ছিল ১০৮ রান। দ্বিতীয় ম্যাচে ১২১ রানে অস্ট্রেলিয়াকে বেঁধে ফেলে বাংলাদেশ টপকে গিয়েছে ৫ উইকেট হাতে রেখে। আর তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের ১২৭/৯-এর জবাবে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে গেছে ১১৭ রানে। চতুর্থ ম্যাচে বাংলাদেশের ১০৪ রান টপকে গেছে অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেট হাতে রেখে। শেষ ম্যাচে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের ১২২ রান পুঁজি নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ৬২ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে বড় লজ্জায় ফেলেছে বাংলাদেশ। ৪-১ সিরিজ হার নিয়ে বাহানা সাজানোর চেষ্টাও হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। কথা উঠেছে উইকেটের ধরন নিয়ে। সাধারণ রীতি অনুযায়ী প্রতিটি দেশই নিজ মাটিতে উইকেট সাজায় বাড়তি সুবিধা আদায় করতে।
এ সিরিজে শেষ ম্যাচে বোলিং পারফরমেন্সের পর সাকিব আল হাসান আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে তার ডাবল পুরো করেছেন। তিনি হলেন প্রথম ক্রিকেটারÑ যিনি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ১০০০ রান করেছেন ও ১০০ উইকেট নিয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্বকাপের আগে ছন্দে ফিরেছেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। এই সিরিজে এক বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণকে বৈচিত্র্য এনে দিয়েছিলেন। মুস্তাফিজের সাথে জুটি বেঁধে শরিফুল ইসলামও নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ রাখেন এই সিরিজে। আসরের চতুর্থ ম্যাচে একটা হাইলাইট হয়ে থাকবে শরিফুল ইসলামের বলে অ্যাস্টন অ্যাগার সোজা ব্যাট চালালে সেটা শামিম হোসেনের দারুণভাবে ডাইভ দিয়ে ধরে ফেলার মুহূর্তটি। এই সিরিজে মাথার অনেক উপরে ওঠা বলগুলোও বাংলাদেশের ফিল্ডাররা মিস করেননি। বৃত্তের ভেতরের বল খুব বেশি বেরোতে দেননি। এই সিরিজে বাংলাদেশের উইকেট কিপিংয়ে দুর্বলতা কাটিয়ে বরং ব্যাটিংয়েও ধাঁধিয়ে দিয়েছেন নবীন ক্রিকেটার নুরুল হাসান সোহান। নবীন দুই স্পিনার মেহেদি হাসান ও নাছুম আহমেদ এই সিরিজ জয়ে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। প্রথম ম্যাচের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন নাছুম আহমেদ। আফিফও তার যোগ্যতা আবারও প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশকে মনে হয়েছে ‘টিম বাংলাদেশ’ খেলছে। বিশ্বকাপের আগে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
অস্ট্রেলিয়া প্রবলভাবে ক্রিকেটপ্রেমী। কিন্তু বাংলাদেশে এসে হোঁচট খেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ১৪৪ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে কম রানের লজ্জা পেয়েছে বাংলাদেশে। সিরিজের শেষ ম্যাচে মাত্র ৬২ রানে অলআউট হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কোনো সংস্করণেই অস্ট্রেলিয়ার ১৩.৪ ওভারে অলআউট হবার ইতিহাস ছিল না। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭৯ রান এবং ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ৮৬ রানে অলআউট হয়েছিল তারা।
রেটিং পয়েন্ট বাড়লেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজে জিতে র‌্যাংকিংয়ে পরিবর্তন হয়নি বাংলাদেশের। তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রতিটি ম্যাচে জয় মানে নতুন কোনো ঘটনা। জয় পেলে র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি হবেই। সিরিজ জিতলেই কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে ধারণা করা হয়েছিল বাংলাদেশ একটি; আর খুব বেশি হলে দুটি ম্যাচ জিততে পারে। সেখানে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে বিস্মিত করেছে ক্রিকেটবোদ্ধাদের। সব মিলিয়ে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বছরে বাংলাদেশের জন্য অস্ট্রেলিয়া সিরিজ বেশ কয়েকটি আশাবাদের বীজ বপন করেছে বটে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল সাজানো এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে সবকিছু।

লেখক : সম্পাদকম-লীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য