Wednesday, October 4, 2023

অমর একুশে বইমেলা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ

স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সোসাইটি গড়তে হলে স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তুলতে হবে। আর স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা।

সাদিকুর রহমান পরাগ: এবারের উত্তরণ-এর সংখ্যায় আমাকে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা নিয়ে লিখতে হবে। ভাবছিলাম কীভাবে লেখাটা শুরু করব। বইমেলা নিয়ে লিখতে গেলে আবার শুরু হলো প্রাণের মেলা, বাঙালির মিলন মেলা- এই শব্দগুলো অবধারিতভাবে চলে আসে। এই শব্দগুলো ব্যবহারে আমার কোনো আপত্তি নাই। বরং বলা যায়, অত্যন্ত আগ্রহ সহকারেই আমি ব্যবহার করব। তবে, আমি ভাবছিলাম যে এই শব্দগুলো ছাড়াও আর অন্য কীভাবে লেখাটা শুরু করা যায়। কীভাবে এই লেখায় বইমেলা এবং স্মার্ট সিটিজেনের মেলবন্ধন ঘটাব।
অবশ্য এ নিয়ে আমাকে খুব বেশি একটা ভাবতে হয়নি। কেননা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ থেকেই লেখার একটা ধারণা পেয়ে গেছি। সে-বিষয়ে যাওয়ার আগে মুঘল সম্রাট আকবরের একটি বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। সম্রাট হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তার সন্তান আকবরকে যখন সিংহাসনে বসতে হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। এ ঘটনা কম-বেশি আমাদের অনেকেরই জানা আছে। এ-রকম বয়সে রাজদায়িত্ব পালনের মতো একটি গুরুভার কাঁধে এসে পড়লে জীবনের ছন্দ কেটে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আকবরের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি।
জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে মুঘলদের বরাবরই আগ্রহ ছিল। আকবরের দাদা বাবর ছিলেন একজন কবি এবং তিনি তার স্মৃতিকথা লিখে রেখে গেছেন। আকবরের পিতা হুমায়ুন একটি বিশাল ও সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মুঘল মহিলারাও ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী। আকবরের খালা গুলবদন বেগম কিংবা পরবর্তীতে আকবরের প্রোপৌত্রী কবি ও দার্শনিক জাহানারার কথাই এ প্রসঙ্গে বলা যায়। রাজপরিবারটি কোথাও বেড়াতে গেলে তখন উটের পিঠে করে তাদের পাঠাগারটিকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হতো।
অথচ এই পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও আকবরের পড়াশোনা আর এগোয়নি। এর কারণ হচ্ছে অল্প বয়সে সিংহাসনে আরোহণের ফলে যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজকার্য পরিচালনার ভার বহন।
পড়তে পারত না বলে জ্ঞান অর্জনের প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিল না সেটিও বলা যাবে না। বিশ্বস্ত পারিষদরা তাকে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও আর্জি পড়ে শোনাত। জানার আগ্রহ থেকেই ফতেপুর সিক্রিতে আকবর একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। নিয়মিতভাবে একটি নির্দিষ্ট করে অন্যরা তাকে সেইসব বই থেকে পড়ে শোনাত। বইয়ের প্রতি, জানার প্রতি আগ্রহ থেকে এভাবেই আকবর তার পাঠের অক্ষমতাকে জয় করেছিলেন।
আবার ফিরে আসি গৌরব ও ঐতিহ্যের অমর একুশে বইমেলায়। কোভিড মহামারির দুঃসহকালকে পিছনে ফেলে ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে এবার ঘটা করেই আয়োজন করা হয়েছে বইমেলার। কোভিড আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলেও আমাদের জ্ঞানের প্রতি স্পৃহা, আমাদের সৃজনশীলতাকে কেড়ে নিতে পারেনি। আর তারই প্রতিফলন যেন আমরা দেখতে পাচ্ছি এবারের বইমেলায়।
বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১১ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এবারের মেলার আয়োজনে ৬০১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১১২টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। লিটল ম্যাগের জন্য রয়েছে ১৫৩টি স্টল।
দুই বছর বিরতির পরে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বশরীরে উপস্থিতি মেলাকে নিঃসন্দেহে মহিমান্বিত ও প্রাণবন্ত করেছে। শুধু তাই নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানাও। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের জন্য ১৫ বিশিষ্টজনের হাতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ তুলে দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
মঞ্চে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ৭টি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন। এর মধ্যে সবিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি-১, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থটির পাঠ বিশ্লেষণ, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাঠ বিশ্লেষণ, আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থটির পাঠ বিশ্লেষণের কথা। এই বই ৪টির মধ্যে প্রথম বইটি সম্পাদনা করেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা।
বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মেলার পাশাপাশি অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন।
একজন রাষ্ট্রনায়কের মতোই তিনি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন তার বক্তৃতায়। বিভিন্ন সংবাদ ও গণমাধ্যমে তার বক্তব্যের সেইসব কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাই এখানে আমি তার আর পুনরাবৃত্তি করছি না। তবে একটি বিষয় নিয়ে বলতে চাই- যে কথাটি আমি এই লেখার শুরুতেও বলেছি। কেন তিনি অন্যদের থেকে আলাদা, কেন তিনি ‘ভিশনারি’- সেটিও কিন্তু তার এই বক্তৃতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।
তার বক্তৃতায় তিনি সাহিত্য চর্চায় প্রযুক্তিগত সুবিধা আরও বেশি করে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। যাপিত জীবনের ব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, সময়ের অভাব, পড়ার প্রতি অনাগ্রহ বিভিন্ন কারণে এখন মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। আর মানুষের এই অনাগ্রহের বিষয়টিও কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃষ্টি এড়ায়নি। আর এই সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও সামনে দেখার ক্ষমতা তাকে করেছে অনন্য। প্রকাশক ও সৃজনশীল লেখক-গবেষকদের তিনি বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি অডিও ভার্সন, ডিজিটাল ভার্সন প্রকাশেরও আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে মানুষ হাঁটতে-চলতেও বইটি শুনতে পারে, জানতে পারে।
মানুষের পাঠের অনাগ্রহ কিংবা পাঠের অক্ষমতাকে জয় করতে তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে বলেছেন। কেউ বই পাঠ করত আর সম্রাট আকবর তা শুনতেন। এভাবেই আকবর তার শ্রবণ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজের পাঠের অক্ষমতাকে অতিক্রম করেছিলেন।
এখন আর সেই যুগ নেই। বসে থেকে এখন আর কাউকে বই পড়ে শোনাতে হবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এখন সহজে সে-কাজটি করা যায়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এ-বিষয়টির কথা উল্লেখ করায় আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে আরেকটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়। এবং বাংলা সাহিত্য আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃতি লাভ করবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সোসাইটি গড়তে হলে স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তুলতে হবে। আর স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। অডিও বই, ডিজিটাল বই, অনলাইন লাইব্রেরি সেই আলোর যাত্রায় আমাদের পাথেয় হবে।
তার ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বটতলায় ৩২টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই মেলা আজ পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের মিলন মেলায়। সারাবছর লেখক-প্রকাশক-পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের এ মহামিলন মেলার জন্য। অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এই বইমেলা আজকে বিশ্বের মাঝে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
আমরা আশা করি, আগামীতে এই মেলা একটি আন্তর্জাতিক মেলার রূপ পরিগ্রহ করে আন্তর্জাতিক এক মিলনমেলায় পরিণত হবে। এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদান আমাদের জানার পরিধিকে আরও ঋদ্ধ ও শাণিত করবে এবং স্মার্ট সিটিজেন তথা স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

পূর্ববর্তী নিবন্ধনামকরণের ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধস্মার্ট বাংলাদেশ – তারুণ্য ভাবনা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য