পেলেকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ‘শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এছাড়া, তার দেশ ব্রাজিলের সরকার তাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
অনিন্দ্য আরিফ দিব্য: ফুটবলকে ঘিরেই ছিল তার রাজ্য। রাজত্ব করেছেন সেখানে দীর্ঘ বছর। অবসরে যাওয়ার পর সেই দায়-দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন উত্তরসূরিরা। তারাও চেয়েছেন ফুটবলের সেই রাজত্ব আঁকড়ে ধরতে। কখনও পেরেছেন, কখনও হয়েছেন ব্যর্থ। পেলে থেকে সক্রেটিস-রিভালদো-রোনালদো থেকে নেইমাররা সেই রাজ্যের সিংহাসন ঘিরেই জমাট রয়েছে। যেমন এবারও কাতারে ছিলেন। মরুস্বর্গের বিশ্বকাপে রাজত্ব জয়ের কয়েকটি খেলা দেখেছেনও। যদিও তখন তিনি ছিলেন বেজায় অসুস্থ। এই তিনি পেলেÑ তারপরও শুধু নিজের দেশ নয়; খোঁজ রেখেছেন বিশ্বকাপ আসরের রাজ্যজয়ের লড়াই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। কিংবদন্তি পেলে আর নিজ চোখে দেখতে পেলেন না ফুটবল রাজ-সিংহাসন দখলের লড়াই। কারণ নানা রোগভোগে ক্লান্ত অবসন্ন সর্বকালের সেরা ফুটবল রাজা পেলে গত ২৯ ডিসেম্বর ৮২ বছর বয়সে চলে গেছেন অন্যলোকে।
পেলের প্রিয় সান্তোসের মাঠ ভিলা বেলমিরোর পাশেই নেকরোপোল একিউমেনিকাতে ঐতিহ্যবাতি অভিজাত কবরখানায় তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে ৪ জানুয়ারি ২০২৩। পেলের দুদিনব্যাপী শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করেছেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। ফুটবলের রাজাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো, দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল ফেডারেশনের (কনমেবল) সভাপতি আলেহান্দ্রো দমিনগেজ, কনফেডারেশন অব ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের (সিবিএফ) সভাপতি এদনালদো রদ্রিগেজ। ছিলেন ব্রাজিলের সাবেক ও বর্তমান অনেক খেলোয়াড়। তবে অনেক নামি-দামি ফুটবলারের অনুপস্থিতি সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। নেইমার স্বশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও পেলের শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন তার বাবা নেইমার সিনিয়র। তিনি জানিয়েছেন, ‘নেইমার নিজে হাজির হতে না পেরেই প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে এখানে যোগ দিতে বলেছেন। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বলেছেন।’
অসুস্থতা এবং স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী পেলের সতীর্থদের অনেকেই শেষযাত্রায় আসতে পারেননি। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যদের মাউরো সিলভা ছাড়া ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে ব্রাজিলের সর্বশেষ দুই বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যরা পেলেকে শেষ বিদায় জানাতে আসেননি। ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যদের মধ্যে কাফু, রিভালদো, রোনালদো, কাকা, রোনালদোরা আসেননি। এমন কী অনুপস্থিত ছিলেন সদ্য-সমাপ্ত কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্কোয়াডে থাকা অনেকেও দেশের ফুটবল ইতিহাসের শেষকৃত্যে।
পেলের শবদেহ সমাধিস্থলে নেওয়ার পথে রাস্তার দু-ধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কারও হাতে ছিল ভালোবাসার পোস্টার-প্ল্যাকার্ড, কারও গায়ে ছিল পেলের বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সি। কেউ কেঁদেছেন অঝোরে, কেউ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন মরদেহ বহনকারী গাড়িতে ফুল ছিটিয়ে। পরিবার থেকেই জানানো হয়, পেলের ইচ্ছে অনুযায়ীই কবরখানার ১৪ তলায় সবচেয়ে উঁচুতে সমাহিত করা হয়েছে। ২০০৩ সালে পেলে এই সমাধিস্থল পছন্দ করে গিয়েছিলেন। এই সমাধিস্থলে রয়েছে একটি সুবিশাল মিউজিয়াম ও আর পাশেই কৃত্রিম জলপ্রপাত। চাইলে দর্শনার্থীরা পেলের কফিন দেখার সুযোগ পাবেন। সমাধিস্থল থেকে সান্তোসের ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়াম সহজেই দেখা যায়। যে মাঠ থেকে শুরু করেছিলেন পেলে তার জীবন উত্থানের গল্প; জীবপটের বিদায়ের গল্পটাও শেষ হলো সেখানেই।
একমাত্র ফুটবলার হিসেবে পেলের দখলেই রয়েছে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০Ñ এই তিন সালের বিশ্বকাপ ট্রফি। তার পুরো নাম এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। তবে মাঠে পায়ের জাদু দেখিয়ে ‘কালো মানিক’ পেলে নামেই খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন। তার জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিনাস গেরাইস প্রদেশে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে যোগ দেন সান্তোসে। সান্তোসের জার্সিতে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বহু সংখ্যক শিরোপা জেতেন পেলে। এরপর জাতীয় দলে সবটাই ইতিহাস। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ফুটবল রাজা। পেলে ৮০টি দেশে ১ হাজার ৩০০-র বেশি ম্যাচ খেলেছেন। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশটির হয়ে ৯২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি, গোল করেন ৭৭টি। যা এখনও ব্রাজিলের কোনো ফুটবলারের পক্ষে সর্বোচ্চ। তার ক্লাব ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব সান্তোসে।
কয়েক বছর আগে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হন পেলে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার শরীর থেকে টিউমার অপসারণ করা হয়। অস্ত্রোপচারের পরও পেলের শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। এর পাশাপাশি হৃদরোগজনিত সমস্যাতেও ভুগছিলেন। ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা কেমোথেরাপিতেও সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তার শরীর। যদিও এর মধ্যেই কাতার বিশ্বকাপ অনুসরণ করে গেছেন পেলে। শারীরিক অবস্থার অবনতির ফলে বড়দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে পেলের পরিবারকে। বেশ কিছুদিন ধরেই হাসপাতালে থাকতে হচ্ছিল পেলেকে। মাঝে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও, অবস্থার অবনতি হওয়ায় আবারও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্রাজিলের হয়ে এই কিংবদন্তি। ৮২ বছর বয়সে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন পেলে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মলাশয় থেকে টিউমার অপসারণের পর থেকে নিয়মিত কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল পেলেকে। এর আগে ২০১২ সালে তার নিতম্বের অপারেশন ব্যর্থ হয়েছিল। তখন থেকেই সাহায্য ছাড়া হাঁটতে অসুবিধা হতো তার।
২০১৩ সালে পেলে নিজের ফুটবল প্রতিভা নিয়ে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর আমাকে একটি কারণে এই ক্ষমতা দিয়েছেনÑ মানুষকে খুশি করার জন্য। আমি যা-ই করি না কেন এই কথাটি আমি কখনোই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি না।’
পেলেকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ‘শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এছাড়া, তার দেশ ব্রাজিলের সরকার তাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
লেখক : সাংবাদিক