সাময়িক সময়ের জন্য সত্যকে আড়াল করে রাখা যায়। কিন্তু সত্যের ধর্ম হচ্ছে একটা সময়ে ঠিকই সে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। যে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু আজ স্বমহিমায় মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
সাদিকুর রহমান পরাগ
এক
বাঙালি জাতির সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনার মাস আগস্ট। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গ্লানিকর ঘটনার মাস আগস্ট। বাঙালি জাতির স্বপ্নভঙ্গের ঘটনার মাস আগস্ট।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার রক্তের স্রোতধারায় ভিজে গেছে বাংলার সবুজ জমিন। বিশ্বাসঘাতকের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে অংকুরেই পুড়ে ছাই হয়েছে একটি জাতির সকল সম্ভাবনা।
ঘাতক বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েছে বাংলাদেশের হৃদয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সাথে ঝাঁঝরা হয়েছে বাঙালি জাতির পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছে স্বপ্নবান তরুণ শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু রাসেল, ভাই শেখ নাসের, শেখ ফজলুল হক মণি, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজি কামাল, আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ অন্য স্বজনদের।
জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্থান করায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দুঃস্বপ্ন এখনও তাড়া করে বেড়ায় তাদের। অন্তহীন এক শোকের সাগর আজও পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন দুই সহোদরা।
একটি প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় তাদের- কীভাবে? কীভাবে পারল তারা? যে মানুষটির নাম বাংলাদেশ নামের সমার্থক, যে মানুষটির জন্ম না হলে এদেশ স্বাধীন হতো না, সেই মানুষটিকে কীভাবে পারল তারা হত্যা করতে?
হয়তো এদেশ আজ অন্ধকার অতীতকে পিছে ফেলে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের পানে ধাবমান, হয়তো এদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে আজ দাঁড়িয়েছে, হয়তো এদেশ জাতির পিতার হত্যার বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে গেছে- কিন্তু যে ক্ষতচিহ্ন ঘাতকরা এই জাতির বুকে এঁকে দিয়ে গেছে, সেই চিহ্ন তো কখনও মুছবার নয়। সে তো কখনও মুছবেও না। এই গ্লানি, এই অক্ষমতা আমাদের তাড়া করে ফিরবে অনাদিকাল।
দুই
এদেশের মানুষের ওপর তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বাস করত বাংলার মানুষ তাকে কখনও হত্যা করবে না, তাকে হত্যা করতে পারে না। অথচ এই বিশ্বাসই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যে কাজটি করার দুঃসাহস পাকিস্তানিরাও দেখায়নি, ১৫ আগস্টে সেটিই হয়েছে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে। বাংলার মানুষের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকের দল সময়-সুযোগ বুঝে স্বরূপে বেরিয়ে এসে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে।
আর এভাবেই তারা প্রতিশোধ নেয় একাত্তরের পরাজয়ের। একদল দুষ্কৃতকারী সেনা কর্মকর্তা ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলেই এতদিন যে বয়ানটি চালিয়ে আসছিল, প্রকৃত ঘটনা যে তা নয়, সেটি আজ উন্মোচিত। সে-সঙ্গে উন্মোচিত আড়ালের ক্রীড়নকের মুখোশ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কি অপরিহার্য ছিল? এর উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ। ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই বলে দেয় কেন ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
তাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই তারা থেমে থাকেনি, রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে এদেশকে পরিচালিত করে পাকিস্তানি ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের পথকে রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে গড়ে তোলা হয় এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি। হত্যা-খুন-দমন-পীড়নের মাধ্যমে এমন একটি নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যাতে কেউ বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার তো দূরের কথা, তার নাম উচ্চারণও করতে সাহস না পায়। সে-সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। সংবিধানকে পদদলিত করে হরণ করা হয় মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার।
সমাজ ও জাতীয় জীবন থেকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল নির্বাসিত। বাঙালি-বাংলাদেশি, ধর্মনিরপেক্ষতা-ধর্মহীনতা, স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করতে সংবিধানে পরিবর্তন ঘটিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। একাত্তরে ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথকে রুদ্ধ করতে দালাল আইন বাতিল করা হয় এবং দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি চিহ্নিত রাজাকারদের উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়ে ক্ষমতার অংশীদার বানানো হয়। বিদেশে পলাতক একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার এবং রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। সে-সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার সেনাসদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। পাঠ্যপুস্তকে ভুল ও বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয় এবং পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির মূলে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এভাবে একটি জাতিকে উল্টোপথে পরিচালিত করা সম্ভব নয়, ঘাতকরা সেটি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, যে মানুষটি নিজেই একটি দেশের মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে, তাকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
তিন
বঙ্গবন্ধুর ঘাতকচক্র ভেবেছিল হয়তো এভাবেই চলবে চিরকাল। কিন্তু বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে আর কেউ এত ভালো করে চিনেনি। চিনেছিলেন বলেই এই জাতিকে তিনি ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংঘটিত করতে পেরেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। চিনেছিলেন বলেই এই জাতিকে তিনি স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সেই যাত্রাপথে সাময়িক বিঘ্ন ঘটলেও, বঙ্গবন্ধুর বাঙালিরা কখনও থেমে থাকে না। মাথানত করে না। তারা অপেক্ষায় ছিল নেতৃত্বের। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে এই জাতি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার।
সাময়িক সময়ের জন্য সত্যকে আড়াল করে রাখা যায়। কিন্তু সত্যের ধর্ম হচ্ছে একটা সময়ে ঠিকই সে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। যে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু আজ স্বমহিমায় মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল, সেই বঙ্গবন্ধুর নাম আজ উচ্চারিত হয় সদর্পে। যে বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্মের কাছ থেকে দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা হয়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধু আজ প্রজন্মের কাছে ফিরে এসেছে অহংকার ও গৌরবের প্রতীক হয়ে।
বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সেই সোনার বাংলা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে। আর আমাদের সেই পথচলাতে আলো হাতে পথ দেখাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
এখনও বঙ্গবন্ধু আমাদের পথ দেখান। এখনও আমরা তার দেখানো পথেই হাঁটি। হয়তো আজকের বাংলাদেশের এই চিত্রটির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ান।
যে ভোর আসার কথা ছিল আসেনি
যে পাখি গাইবার কথা ছিল গায়নি
যে মেঘ ঝরবার কথা ছিল ঝরেনি