নুসরাত হত্যা মামলার রায়
উত্তরণ প্রতিবেদন: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায়ে প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয়েছে। গত ২৪ অক্টোবর জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ আদেশ দেন। এছাড়া রায়ে প্রত্যেক আসামিকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানার অর্থ আইন মোতাবেক আদায় করে ভিকটিমের পিতা-মাতাকে দেওয়ার জন্য ফেনীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। হত্যার সাত মাসের মাথায় এই রায় দেওয়া হলো। নারীর মর্যাদা রক্ষায় নুসরাতের এই আত্মত্যাগ তাকে অমরত্ব দিয়েছে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। ১৭৩ পৃষ্ঠার এই রায় প্রদানের সময় চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার সব আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নুসরাতের পরিবার ও আইনজীবীরা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেনÑ অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মো. জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, মাদ্রাসার শিক্ষক আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, এমরান হোসেন ওরফে মামুন, মো. শামীম, মাদ্রাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন ও মহিউদ্দিন শাকিল।
রায়ে যা বলা হয়েছে : বিচারক আদালতের রায়ে উল্লেখ করেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাটি ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। ২ হাজারেরও অধিক ছাত্রছাত্রী সেখানে অধ্যয়নরত। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে মাদ্রাসাটির আলোকোজ্জ্বল ভ‚মিকায় কালিমা লিপ্তকারী এই হত্যার ঘটনাটি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীর মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতোমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এই অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে বিধায় দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য। আদালত বলেছেন, মামলার ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফিকে বিগত ০৬.০৪.২০১৯ সকাল ৯.৪৫-৯.৫০ মিনিটের মধ্যে মাদ্রাসার সাইক্লোন সেল্টারের তৃতীয় তলার ছাদে ডেকে নিয়ে ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত/০৩)-এর ৪(১)/৩০ ধারায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হলো। রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, দণ্ডিত আসামিবৃন্দ অত্র রায় ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিবৃন্দের ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ’ অনুমোদনের জন্য অত্র মামলায় যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্ট বিভাগে সত্বর প্রেরণ এবং আসামিবৃন্দ বরাবর সাজা পরোয়ানা ইস্যু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া অত্র মামলার জব্দকৃত আলামত গ্লাস, বোরখা, ওড়না, সালোয়ারের পোড়া অংশ, ম্যাচের কাঠি, মোবাইল, সিডি, নেভি ব্লু কালারের একজোড়া জুতা, কেরোসিন মিশ্রিত পলিথিন, ড্রাম, চুঙ্গি, ভিকটিমের লেখার খাতা, পরীক্ষার খাতা রাষ্ট্রের অনুক‚লে বাজেয়াপ্ত করা হলো বলে রায়ে নির্দেশ প্রদান করা হয়। এসব দ্রব্যসামগ্রী আলামত হিসেবে ফেনী জেলখানায় প্রেরণ এবং বিধি মোতাবেক ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফিরে দেখা : ২৭ মার্চ মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তার মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে। মামলা তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার একটি ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরখা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান মামলা করেন। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাত মারা যান। ভাইয়ের করা অগ্নিসন্ত্রাসের মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। গত ২৮ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই তদন্ত শেষে অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।