সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ: অটিজম, পুরো নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিসর্ডার বা এএসডি, একটি স্নায়বিক বিকাশ সংক্রান্ত সমস্যা, যা শিশুর সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ এবং আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। স্পেকট্রাম মানে বর্ণালি, তাই একজন অটিজমের শিশুকে ‘অটিস্টিক’ না বলে বলা যেতে পারে ‘অটিজম বর্ণালির শিশু’। যেহেতু অটিজম বর্ণালির বেশিরভাগ শিশুই সময়ের সাথে সাথে বসতে, হামাগুড়ি দিতে এবং হাঁটতে শিখবে, তাই প্রথম দিকে শিশুটির সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতার ওপর আপনার নজর নাও পড়তে পারে।
অটিজম অক্ষমতা নয়, এটা ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা : অটিজম কোনো শিশুর অক্ষমতা নয়; বরং এটা অটিজম বুঝতে না পারার আমাদের অক্ষমতা। অটিজম এবং কীভাবে এটা শিশুর মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে, এ ব্যাপারে আমরা আজও অনেক কিছুই জানি না। একজন অটিজম বর্ণালির শিশু তার নিজস্ব পৃথিবীতে বাস করে; কিন্তু সেই পৃথিবীতে কীভাবে প্রবেশ করতে হয় তা আমরা অনেকে জানি না। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের মস্তিষ্কের অন্তর্জাল সম্বন্ধে অনেক কিছুই শিখিয়েছে, তথাপি অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা নেই।
শিশুর অটিজম কীভাবে বুঝবেন?
সামাজিক যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার দক্ষতা : কজন অটিজম বর্ণালির শিশুর কাছে সামাজিক যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার দক্ষতা একটু কঠিন হতে পারে। যেমন : * সরাসরি আই কন্টাক্ট করে না * ৯ মাস বয়সের আগে নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না * ৯ মাস বয়সের আগে সুখ, দুঃখ, রাগ, আশ্চর্যের অভিব্যক্তি চেহারায় প্রকাশ পায় না * ১২ মাস বয়সের আগে হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি দেখায় না। যেমন- টাটা, গুডবায় ইত্যাদি * ১৮ মাস বয়সের আগে আপনি আঙ্গুল দিয়ে যেদিকে দেখাচ্ছেন সেদিকে তাকায় না * দু-বছর বয়সের আগে অন্যের দুঃখ বা আঘাত বুঝতে পারে না * তিন বছর বয়সের আগে অন্যের অনুভূতি বুঝতে বা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না।
পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ : খেলনা লাইন করে সাজিয়ে রাখে এবং অন্য কেউ সেটি নষ্ট করলে রাগ করে * একই শব্দ বা বাক্য বারবার বলে * খেলনা নিয়ে সব সময় একইভাবে খেলা করে * খেলনার কোনো কিছুর দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। যেমন- গাড়ির চাকার দিকে তাকিয়ে থাকে * সামান্য পরিবর্তনে ক্ষেপে যায় * কিছু কিছু ব্যাপারে খুব বেশি আবেগপূর্ণ। যেমন- যাকেই দেখবে তার জন্মদিন কবে জিজ্ঞেস করবে; কিংবা দরজা বারবার খুলবে ও বন্ধ করবে * কিছু রুটিন অবশ্যই মেনে চলতে হবে * হাত ঝাপটানো বা ফ্ল্যাপিং * শরীরকে দুলানো বা একটি বৃত্তের মধ্যে শরীরকে ঘুরাতে থাকা * শব্দ, গন্ধ, অনুভূতি বা স্বাদের প্রতি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : দেরিতে কথা বলতে ও বুঝতে শেখা * চলাফেরা দেরিতে শেখা * চিন্তাশক্তি ও শেখার ক্ষমতা দেরিতে হওয়া * অতি সক্রিয় বা আবেগপ্রবণ আচরণ * মৃগী রোগ * অস্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুমানোর অভ্যাস * উদ্বেগ, মানসিক চাপ বা খুব বেশি চিন্তিত * ভয়ের অভাব বা অতি মাত্রায় ভয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে একজন অটিজম বর্ণালির শিশুর মধ্যে উপরোক্ত সব উপসর্গ বা কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে।
শিশুটির সাথে কীভাবে সংযোগ স্থাপন করবেন : ডাক্তারের চিকিৎসার বাইরে কিছু কিছু ক্ষুদ্র জিনিস আপনি করতে পারেন, যা শিশুটির কাছে মনে হতে পারে অনেক বড় কিছু পাওয়া।
ইতিবাচক দিকে ফোকাস করুন : শিশুটির ভালো কাজের প্রশংসা করুন এবং তাকে সেই কাজের জন্য উপহার দিন। শিশুকে কোনো কাজে উৎসাহিত করা এবং তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশই মূল লক্ষ্য।
* অটিজম বর্ণালির শিশু সবকিছু আক্ষরিকভাবে নেয়। যেমনÑ আপনি যদি তাকে অপেক্ষা করতে বলার সময় বলেন ‘একটু দাঁড়াও’, তাহলে সে দাঁড়িয়ে পড়বে।
রুটিন মেনে চলুন : যেহেতু ওরা রুটিন মেনে চলতে চায়, তাই তাদের নতুন কোনো দক্ষতা বা আচরণ শেখানোর সময় রুটিন মেনে চলুন।
খেলার ছলে শেখা : এমন কিছু উপায়ে শেখাতে চেষ্টা করুন, যাতে শিশুটি মনে করে এটা এক ধরনের খেলা এবং কঠিন কোনো শিক্ষা নয়।
ধৈর্য এবং সময় : আপনাকে বিভিন্ন ধরনের টেকনিক, চিকিৎসা এবং পন্থা চেষ্টা করে বুঝতে হবে কোনটা আপনার শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো। ইতিবাচক মনোভাব রাখুন এবং ধৈর্য হারাবেন না।
বাইরে গেলে শিশুকে সাথে নিয়ে যান : প্রতিদিন যখন বাজার করতে, শপিং মল, এটিএম থেকে টাকা তুলতে ইত্যাদি জায়গায় যাবেন, শিশুকে সাথে নিয়ে যাবেন। তাকে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে শেখাবেন এবং কীভাবে এসব কাজ করতে হয় সে-ব্যাপারে ট্রেনিং দেবেন।
সাপোর্ট গ্রুপ : অনলাইনে বা সামনাসামনি অন্যান্য অটিজম বর্ণালির শিশুদের পিতামাতার সাথে যোগাযোগ রাখুন। একটা সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করতে পারেন, যেখানে সবাই মিলে শিশুদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। আপনার শিশুকে গ্রুপের অন্য শিশুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে উদ্বুদ্ধ করুন।
লেখক : খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক